রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি

মোহাম্মদ আব্দুল গফুর:

ভাষা সৈনিক আব্দুল গফুর
ভাষা সৈনিক আব্দুল গফুর

সৃষ্টি জগতের সবচাইতে উপরে মানুষের স্থান। মানুষকে বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বপালকের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই দায়িত্ব পালনে অন্যান্য মানুষের সাথে তার মনের ভাবের আদান-প্রদানের প্রয়োজন অপরিহার্য। মানুষ নানাভাবেই তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মানব শিশু জন্মের পর পরই কান্নার মাধ্যমে এ জগতে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। বড় হয়ে মানুষ হাসি-কান্না ছাড়াও নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। তবে মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষের সবচাইতে উপযোগী মাধ্যম হচ্ছে ভাষা।

ভাষার মধ্যেও আবার মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করা যত সহজ, আর কোনো ভাষার মাধ্যমে তেমন সহজ নয়। মাতৃভাষা শিখতে কারো স্কুল-কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। শৈশবকালে মায়ের কোলে থাকতেই মানবশিশু মাতৃভাষা শিখে ফেলে। এ জন্যই ভাষার মধ্যে মাতৃভাষার মূল্য সবচাইতে বেশী। এ কারণেই স্রষ্টা পৃথিবীতে যুগে যুগে তাঁর জীবনবিধান নিয়ে যত প্রেরিত পুরুষ পাঠিয়েছেন, তাদের সবাইকে পাঠিয়েছেন স্ব-স্ব জনগোষ্ঠী বা কওমের ভাষা তথা মাতৃভাষায়। কারণ যে-কোনো জাতির শিক্ষা ও উন্নতির জন্য মাতৃভাষার ব্যবহার সবচাইতে উপযোগী।

একই কারণে যে-কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের মাতৃভাষা যদি রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে ব্যবহৃত হয় তাহলে সে রাষ্ট্রের উন্নতির গতি ত্বরান্বিত হয়। আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালে আমরা দেখতে পাই, পলাশী বিপর্যয় থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এ ১৯০ বছরের পরাধীনতার আমলের সিংহভাগ ইংরেজি ছিল এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে ভাবী স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ভারতবর্ষ স্বরাজ লাভ করলে স্বাধীন ভারতের সাধারণ ভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন করে মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পত্র লিখলে জবাবে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : ভারতের সাধারণ ভাষা তথা আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হতে পারে হিন্দি।

তবে রবীন্দ্রনাথের আহূত এক আলোচনা সভায় বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানান, উপমহাদেশের তিনটি প্রধান ভাষা বাংলা, হিন্দি ও উর্দু— তিনটি ভাষারই স্বাধীন রাষ্ট্রের সাধারণ ভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।

সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের হিন্দি-প্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের মধ্যে উর্দু ভাষার প্রতি একটা সাধারণ দুর্বলতা ছিল। এ ছাড়া প্রাচীন ও আধুনিক ইসলামী শিক্ষার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কেন্দ্র দেওবন্দ ও আলীগড় উভয়েরই অবস্থান উর্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলে হওয়ায় আমাদের দেশেরও প্রাচীন ও আধুনিকপন্থী অনেক শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে উর্দু ভাষায় কথাবার্তা বলাকে আভিজাত্যের ব্যাপার মনে করা হতো।

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটির নেতৃত্বে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, অপরটির নেতৃত্বে ছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। কংগ্রেস ছিল অখণ্ড ভারতের সমর্থক। অপরদিকে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে এক প্রস্তাবে ভারতবর্ষকে হিন্দু প্রধান ও মুসলমান প্রধান অঞ্চলে এমনভাবে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যার প্রতিটি ইউনিট এক একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর লীগ-কংগ্রেস উভয় দলই এই ফর্মুলা মেনে নিতে সম্মত হয়।

্রেওেুোিুিা

এদিকে ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে মুসলিম লীগ দলীয় আইন সভার সদস্যদের (লেজিসলেটারদের) এক কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাবের আংশিক সংশোধন করে উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে একাধিকের বদলে আপাতত একটি (পাকিস্তান) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবের উত্থাপক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর প্রস্তাব উত্থাপনকালীন ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, ‘অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন : পাকিস্তানই আমার শেষ দাবী কিনা? আমি এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেব না। তবে এ কথা আমি অবশ্যই বলব, এ মুহূর্তে পাকিস্তানই আমার প্রধান দাবী।’ অর্থাৎ তিনি লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলিম-অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন না। যাই হোক এই দিল্লী প্রস্তাব মোতাবেক ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে এবং পূর্ববঙ্গকে রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হিসেবে নিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়।

এদিকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসুর উদ্যোগে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে একটি বৃহৎ সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চলে তার প্রতি মুসলিম লীগ নেতা কায়দে আজম জিন্নাহর সমর্থন থাকলেও গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেস নেতা এবং হিন্দু মহাসভার বাঙালী নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রবল বিরোধিতার কারণে সে উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এদের শেষোক্ত শ্যামাপ্রসাদ এমনও দাবী করেন, ভারত বিভাগ না হলেও বাংলা বিভাগ হতেই হবে, নইলে নাকি হিন্দুরা অবিভক্ত বঙ্গদেশে স্থায়ী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়ে পড়বে।

১৯৪৭ সালে যদি ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ অখণ্ড অবয়বে স্বাধীনতা লাভ করত, সে ক্ষেত্রে হিন্দিভাষীদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলাই সম্ভব হতো না। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে যদি লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হতো— পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রভাষা হতো বাংলা। তা ছাড়া যদি সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর বৃহত্তর সার্বভৌম পরিকল্পনা সফল হতো তারও রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতো। কিন্তু এ সব না হয়েও যেভাবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হল, দেখা গেল তারও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা। ফলে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলা সহজ হল।

রেওে

১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিস ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে এই পটভূমিতেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। এই পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন— তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ। এদের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখায় ভাষা আন্দোলনের মূল দাবী এভাবে তুলে ধরা হয় : (১) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি— বাংলা ও উর্দু। (২) প্রাদেশিক অফিস-আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।

এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে সে সিদ্ধান্ত কংগ্রেস আগে-ভাগেই গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণের আগেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দু হওয়া উচিত বলে অভিমত প্রকাশ কলে বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার তীব্র প্রতিবাদ জানান।

রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গৃহীত না হলেও নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনে অবাঙ্গালী উচ্চপদস্থ আমলাদের আধিক্যের কারণে ভেতরে ভেতরে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত চলতে থাকে। এ চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, এনভেলপ প্রভৃতিতে ইংরেজির সাথে শুধু উর্দুর ব্যবহার দেখে। এই চক্রান্তের বিষয়ে আঁচ করতে পেরেই তমদ্দুন মজলিস ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে।

শুধু পুস্তিকা প্রকাশ করেই তমদ্দুন মজলিস বসে থাকেনি এই দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তি সংযোগ, আলোচনা বৈঠক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। এ সব কাজে প্রধান উদ্যোগ ছিল তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের। ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ফজলুল হক হলে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে বাংলা ভাষার আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

১৯৪৭ সালের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের শ্বেতাঙ্গ সচিব মি. গুডইন কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস যে বিষয় তালিকা প্রকাশ করেন তাতে উর্দু ও ইংরেজির সাথে সংস্কৃত ও ল্যাটিনের মতো মৃত ভাষা স্থান লাভ করলেও বাংলা স্থান পায়নি। এর বিরুদ্ধে অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে তা প্রকাশিত হয়। সঙ্গে প্রকাশিত হয় ‘অবিশ্বাস্য’ শীর্ষক এক কড়া সম্পাদকীয়। তখন ঢাকা থেকে কোনো দৈনিক প্রকাশিত হতো না। দৈনিক ইত্তেহাদের ওই সংখ্যা ঢাকা এসে পৌঁছলে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়।

্রও

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্বতন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে তমদ্দুন মজলিসের অবস্থান সমর্থন করে। তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়।

এ সময়ে করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের এক অধিবেশনে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবী জানান। সে দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়।

এর প্রতিবাদে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহূত হয়। প্রতিবাদ দিবসের এই ধর্মঘট বিপুল সাফল্যমণ্ডিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে রেল কর্মচারীদের সমর্থন থাকায় ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে কোনো ট্রেন রওনা হতে পারেনি। তখন সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে দেয়াল ছিল না, ছিল কাঁটাতারের বেড়া। এই কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে অনেকে ভিতরে ঢুকে পড়ে।্রেওেুোিুিা

১১ থেকে ১৫ মার্চ ঢাকা শহরের সর্বত্র ভাষার দাবীতে বিক্ষোভ চলতে থাকে। তৎকালীন প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন এতে ভয় পেয়ে যান। কারণ ১৯ মার্চ কায়েদে আজমের ঢাকা সফরের কথা। খাজা নাজিমুদ্দিন পরিস্থিতি শান্ত করতে বাংলা সমর্থকদের সব দাবী-দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে আপাতত শান্ত হয় পরিস্থিতি। এর পর কায়দে আজম ঢাকায় এসে প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ও পরে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দেন। উভয় ভাষণে তিনি উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করণের ঘোষণা দেন। উভয় স্থানে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়। রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় এ প্রতিবাদ জিন্নাহ টের না পেলেও সমাবর্তনে সীমিত উপস্থিতিতে কিছু তরুণ যখন ভাষা সম্পর্কিত তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়, তিনি বিস্মিত হয়ে থমকে যান এবং বক্তৃতা সংক্ষেপ করে চলে যান। পরে তিনি বাংলা ভাষা সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকায় বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। তবে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আর কোনো বক্তব্য দেন নি। বিপ্লবী ভাষাসৈনিক জনাব অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, সে সময় কায়দে আজম জিন্নাহর বিপুল জনপ্রিয়তা থাকায় তাঁর সুস্পষ্ট মতামতের ঐ মুহূর্তে ভাষা আন্দোলন নতুন করে জোরদার করে তোলা সম্ভবপর হয়নি।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। ১৯৪৯ সালে বাংলা হরফ বদলানোর এক চক্রান্ত হলে তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবাদ জানালে সরকার এ প্রশ্নেও পিছটান দিতে বাধ্য হয়। এর পর ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসে ২৭ জানুয়ারি তারিখে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন— উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবী মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তাঁর এ ঘোষণা বিশ্বাসঘাতকতা বলে সবার কাছে প্রতিভাত হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

এর পরের ইতিহাস সবার জানা। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তরুণদের রক্তদানের পর বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে কেউ আর কখনো চক্রান্ত করার সাহস পায়নি এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়।

১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিসের প্রকাশিত পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকায় লাহোর প্রস্তাবের যে উল্লেখ ছিল সে প্রস্তাবের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হিসেবে উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে যে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সে লক্ষ্যও অর্জিত হয়েছে ১৯৭১ সালে। সে নিরিখে বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল হিসেবেই আজ আমরা বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক।

ভাষা আন্দোলন আপাতত সফল হয়েছে। এমনকি এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হিসেবে— বাংলা ভাষাভাষীদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশও আজ বাস্তবতা। তারপরও বলতে হয়, ভাষা আন্দোলন আজও শেষ হয়নি। অফিস-আদালতে ব্যবহারের জন্য পরিভাষা তৈরির কাজ এতদিনেও শেষ হয়নি। এটা জাতির জন্য লজ্জার কথা। আজও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশে আমাদের আফিস-আদালতে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা নয়, ইংরেজির ব্যবহার চলে। তা ছাড়া এদেশেরই বহু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যম স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এটা আনন্দের কথা। কিন্তু আজও আমাদের আশপাশের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেনি।

দুঃখজনক বিষয় বাংলা শুধু উপমহাদেশের নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম বহুল-ব্যবহৃত ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা এখনও জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। এ স্বীকৃতি আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন সমাপ্ত হয়েছে মনে করার কোনো অবকাশ নেই। সেই নিরিখেই বলতে হয়, ভাষা আন্দোলন শেষ হয়নি। বাংলা ভাষা আন্দোলনের কর্মী ও সমর্থকদের বরকত, রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে আরও বহু সংগ্রাম ও সাধনা করতে হবে। সেই গৌরবময় লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে হবে।

ুুিুিৃাি

আমরা সবসময়ই দাবী করে থাকি, বাংলা ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল আজকের স্বাধীন রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তাই ভাষা আন্দোলনের সাথে আমাদের এই প্রিয় রাষ্ট্রটির উন্নত ও শক্তিশালী হওয়ার প্রশ্নও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিধাতা বাংলাদেশকে দিয়েছে পৃথিবীর ঊর্বরতম জমি এবং পাহাড় ও দরিয়ার নিচে সাজানো প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদরাজী। সর্বোপরি রয়েছে অল্পে তুষ্ট পরিশ্রমী বিপুল মানবসম্পদ। এত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি স্বাধীন দেশের তো এতদিনেও পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশসমূহের কাতারে আটকে থাকা শোভনীয় নয়।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় আমাদের এই বিপুল সম্ভাবনাময় দেশের পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী প্রধানত এক শ্রেণীর রাজনীতিক। আমাদের এই স্বাধীন দেশে আজও গণতন্ত্র শক্ত শিকড় গাড়তে পারছে না প্রধানত এক শ্রেণীর রাজনীতিকের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও স্বার্থপরায়ণতার কারণে। তারা নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এতটাই শত্রু ভাবেন যে, তাদের শায়েস্তা করতে তারা অনায়াসে সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী অপশক্তির পায়ে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও প্রস্তুত থাকেন। ফলে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী অপশক্তিসমূহ এই সম্ভাবনাময় দেশটির সম্পদ লুটপাটের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে।

ভাষা আন্দোলনের সাথে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে বলেই যতদিন ভাষা আন্দোলনের গৌরবজনক ফসল বাংলাদেশ সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ, উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে না ওঠে, ততদিন ভাষা আন্দোলনের কাছে এ দেশবাসীর ঋণ প্রতিশোধ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস ফেব্রুয়ারিতে সেই অনাগত সুদিন ত্বরান্বিত করার সাধনাই হোক আমাদের সবার প্রধান লক্ষ্য।

লেখক : ভাষাসৈনিক. সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *