শরীফ আবদুল গোফরান ::
বাংলাভাষা বাঙালি মুসলিমদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা। এ কথা সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর পূর্বে কোনো অভিজাত মুসলিম এমন দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনিই উপমহাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯১১ সালে রংপুরে মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে তখনকার রক্ষণশীল পরিবেশেও বাংলা ভাষার পক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন। তিনি যুক্তি সহকারে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার জোর সুপারিশ করেন।
কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে ভারত বর্ষের একটি সাধারণ ভাষার প্রশ্ন প্রবল হয়ে দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতে রাষ্ট্রভাষা রূপে হিন্দির পক্ষে দাবি তোলেন। বাংলার বাইরের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিমদের রায় ছিল উর্দুর পক্ষে। কিন্তু বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে থেকেই এ সময় বাংলার পক্ষে আওয়াজ উঠে।
১৯১৮ সালে ‘‘বিশ্বভারতীতে” অনুষ্ঠিত এক সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের হিন্দি সম্পর্কিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলাভাষার দাবি পেশ করেন। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সারা ভারতের ভাষাতত্ত্ববিদ ও পণ্ডিতগণ সে সভায় উপস্থিত হন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বভারতীয় সভায় ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি পাঠ শেষ হলে সভাস্থলে মহা হই চই পড়ে যায়।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি সমকালীন “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (১ম বর্ষ, ১ম খণ্ড, বৈশাখ, ১৩২৭/১৯২০ খ্রি.)
[তথ্য : ভাষা আন্দোলনের ডায়েরি, মোস্তফা কামাল, পৃ. ১৩]
১৯২১ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লিখিতভাবে দাবি উত্থাপন করেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। দাবি নামায় তিনি লিখেন : ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে।
১৯৩৭ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, ‘দৈনিক আজাদ’-এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন, “সাহিত্যের মধ্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলা ভাষায় বিবিধভাব প্রকাশের উপযোগী শব্দের সংখ্যাই বেশি। অতএব বাংলা ভাষা সব দিক দিয়াই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবি করিতে পারে। মহাত্মাগান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাব করিয়াছে বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলা ভাষার চেয়ে হিন্দির যোগ্যতা কোনো দিক দিয়েই বেশি নহে।”
[ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক প্রেক্ষাপটে আমাদের ভাষার লড়াই, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি স্মারক]
পাকিস্তান আমলের ভাষা আন্দোলনের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে সাতচল্লিশের ভারত বাটোয়ারার ভিত্তিতে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে সাতচল্লিশের আগস্ট মাসে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম না হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করার ক্ষেত্রই তৈরি হতো না।
কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা ঊনিশ শতক ও কুড়ি শতকের প্রেক্ষাপটে বাংলাভাষা চর্চায় এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে হিন্দির কাছে সমর্পিত হয়ে সাংস্কৃতিক আত্মবিলোপের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন। তাদের চাইতে অনগ্রসর, অর্থনৈতিকভাবে শোষিত ও বঞ্চিত, কৃষিজীবী মুসলিম অধ্যুষিত অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে স্বাধীন হলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি সম্ভব হতো না সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা। বরং অখণ্ড ভারতে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিমদের অবস্থা কি হতো তা বুঝার জন্য আজকের অধিকৃত কাশ্মীর এবং পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অবস্থার দিকে নজর দিলেই তা সহজেই বুঝা যায়।
ফলে ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের শঠতা, প্রবঞ্চনা ও চক্রান্তমূলক বাটোয়ারা কৌশলের ফসল হিসেবেই পাকিস্তান আন্দোলনের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের মানসিক পর্ব শুরু হয়।
বাঙালি মুসলিমগণ ঢাকায় বাংলা ভাষার রাজধানী করার সংগ্রাম ও কোরবানীর পথে অগ্রসর হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
ভাষা আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্ব
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দু’বছরের মধ্যে কলিকাতা ও ঢাকায় যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে দু’টি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান দু’টির বিভিন্ন সভায়ও বহুবার বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা আলোচিত হয়। ১৯৪৩ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সম্মেলনে সংসদের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের বাহন হবে বাংলা ভাষা এ প্রশ্ন বহু পূর্বেই চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়ে গেছে।”
সভাপতি হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে আবদুল মওদুদ বলেন, “পশ্চিম ও উত্তর ভারতে যেমন ভাষা বিজ্ঞানে মুসলিমদের শ্রেষ্ঠ অবদান উর্দু ভাষা, সেই রকম পূর্ব ভারতে মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে বাংলাভাষা।” এ সময় রেনেসাঁ সোসাইটির উৎসাহী সমর্থক কবি ফররুখ আহমদ বাংলার সমর্থনে এবং এক শ্রেণীর উর্দু প্রেমিক বঙ্গ-সন্তানদের তীব্র সমালোচনা করে “উর্দু বনাম বাংলাভাষা” শীর্ষক ব্যঙ্গ সনেট রচনা করেন। এ সনেট ১৩৫২ বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তমুদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র শিক্ষকের সহযোগিতায় ভাষা আন্দোলনের এই জনক সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে তমুদ্দুন মজলিস ছিল একটি চমকে দেয়া বিপ্লবী নাম। ভাষা আন্দোলনে মজলিসের মুখপাত্র “সৈনিক” পত্রিকার এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে খ্যাতনামা শিল্পী জয়নুল আবেদীনের অভ্যর্থনা উপলক্ষ্যে এক সভায়ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করা হয়।
১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে এক ছাত্রসভায় অংশগ্রহণ করেন। তখন ছাত্র সমাজের পক্ষ থেখে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দাবি সম্বলিত এক ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ঢাকসুর তৎকালীনর জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম স্মারকলিপি পাঠ করেন এবং হস্তান্তর করেন। এই স্মারকলিপিটি গ্রন্থনায় ছিলেন বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী। পরবর্তীতে এ দাবিগুলোর ভিত্তিতে এ দেশে জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীকার আন্দোলন গড়ে উঠে।
স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতচল্লিশ সাল এবং তারপরবর্তী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের হাজার বছরের ভাষার লড়াইয়ের ধারাবাহিকতার একটি অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়।
ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পর্ব
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় তমুদ্দুন মজলিস-এর উদ্যোগে পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের হয়। তখন তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ও গঠিত হয়। এ পরিষদ নানা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট এবং প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি মাইলফলক। এ ধর্মঘটের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৭ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে উর্দুর সাথে সাথে বাংলাভাষাকেও সমান মর্যাদা প্রদান এবং পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ফলে এ দেশের মানুষ ধরে নিয়েছিল তারা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা ফিরে পাবে। কিন্তু সরকার অচিরেই এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সাকে পদদলিত করলো। ১১ মার্চ থেকে ২১ মার্চ এর মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ২১ মার্চ পাকিস্তানের জনক ও তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে এলেন। তখন কার্জন হলে আয়োজিত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অপর কোনো ভাষা নয়।’ কায়েদে আযমের এ ঘোষণা ছিল এ দেশের মানুষের স্বপ্ন আকাক্সার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত। তাই এ ঘোষণার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো দেশ। ফের শুরু হলো ভাষার আন্দোলন। প্রতিবাদ প্রতিরোধে কেঁপে উঠলো সারাদেশ। ভাষার দাবিতে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও স্লোগানে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। মানুষ আশা করেছিল সরকার এ দেশের জনগণের দাবিকে মর্যাদা দেবে এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেবে। ঘটনা ঘটলো উল্টো। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশন। এখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন : ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ দেশের মানুষ আরেকবার হতাশ হলো। তারা আর স্থির থাকতে পারলো না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিবাদে আবার জেগে উঠলো দেশ। ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় পালিত হলো প্রতিবাদ দিবস।
এখানেই থেমে থাকেনি দেশের মানুষ। তাদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ তীব্র হতে থাকলো। ফলে ভাষার আন্দোলন আরো সংগঠিত হলো। ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবার জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে গঠিত হলো ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ নামে। শুরু হলো নতুন উদ্যমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।
ভাষা আন্দোলনের বিজয় পর্ব
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং জারি করল ১৪৪ ধারা। কিন্তু তাতেও মানুষের ক্ষোভকে থামানো যায়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের। বিুব্ধ ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পুলিশ মিছিলের উপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে ৩ জন ছাত্রসহ ৪ ব্যক্তি নিহত হন, ১৭ জন আহত হন এবং গ্রেফতার হন ৬২ জন। পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হন তারা হলেন রফিক উদ্দিন আহমদ (মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র), আবদুল জব্বার (গ্রামীণ কর্মচারী), আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ কাসের ছাত্র), মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এম এ কাসের ছাত্র) এবং আবদুস সালাম (শুল্ক বিভাগের পিয়ন, আহত অবস্থায় ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন)। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাজা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তাদের ভাষা, স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা নিরাপদ নয়। তাই ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মানুষ অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফল হিসেবে আমরা যে স্বাধীনতা পেলাম তা আজ আমাদের পরম পাওয়া। তাই ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানীরা আমাদের সবার কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। আমরা তাদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
আমাদের এ মহান ভাষা আন্দোলন এবং তারই পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের দরবারে আমাদের গৌরবকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। আমরা আরো বেশি গর্বিত হয়েছি যখন আমাদের ভাষা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা এখন ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’র স্বীকৃতি পেয়ে গৌরবের আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর এ মহান কাজে যারা অবদান রেখেছেন তারাও বাংলাদেশী। তারা এ জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বিশ্বে বাংলাভাষী জনগণের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পাকিস্তান, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ মালয়েশিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী বসবাস করছেন। জাতিসংঘ শান্তিবাহিনীতে বাংলাদেশের বাংলাভাষী সৈনিকদের কর্মকাণ্ডে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আফ্রিকান দেশ সিয়েরালিয়ন বাংলা ভাষাকে সে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে থেকে পাকিস্তান ও ভারতে বাংলাভাষা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এদিক থেকে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইতোমধ্যে মর্যাদার দাবিদার।
জাতিসংঘ যেসব ভাষাকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে তার বেশিরভাগই বাংলার চেয়ে কম প্রচলিত। ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বাংলা ভাষার কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাংলাভাষী জনগণের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ভাষার প্রতি বাংলাভাষী জনগণের দরদ বিশ্বের সকল ভাষার সুরক্ষার ও যথাযথ স্বীকৃতির পথ দেখিয়েছেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনিসেফের এক বৈঠক বসে প্যারিসে। সভার ১৮৮ জন সদস্যের সমর্থনে আমাদের ভাষা সেদিন অমর মর্যাদা লাভ করে। এর আগে বিশ্বের ২৮টি দেশ বাংলাভাষাকে জাতিসংঘে উত্থাপনের সমর্থন জানায়। বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাবার পেছনে কানাডা প্রবাসী একদল বাংলাদেশী নাগরিকের অবদান ছিল সীমাহীন। তাদের সংগঠনের নাম ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট’ এর নেতা ছিলেন জনৈক রফিকুল ইসলাম। এছাড়াও যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন জ্যাসন মেরিন, সুসান হভগিল, ড. কেলভিন চাও, বিনতে মারটিনস, করুনা জোসি, নাজনিন ইসলাম, আবদুস সালাম প্রমুখ।
আজ বাংলা ভাষার যে মর্যাদা নিয়ে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছি তাকে অর্থবহ করতে হলে ভাষার মান উন্নয়নে আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে। মনে রাখা দরকার, বাংলাভাষা এখনও দেশের রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ সিয়েরালিয়নের সরকারও বাংলাকে ভালোবেসে তাদের দেশের অন্যতম ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আমাদের সরকার বাংলাভাষার উন্নয়নে সঠিক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।