বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক অনগ্রসর দেশ থেকে দরিদ্র-অসহায় শিশুদের নিয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মরুপ্রান্তরে উটের রেস খেলার জকি বানানো হতো। নির্মম এ খেলায় শিশুদের জোরপূর্বক উটের পিঠে বেঁধে রেস শুরু হতেই ওদের কান্নার ভয়ার্ত শব্দ শুনে উট আরও জোরে দৌড়াতে শুরু করত। ফলে শিশুরা উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই আহত হতো। বাংলাদেশে এর চেয়েও কিছু নির্মম কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দরিদ্র, অসহায়, অধিকারবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের। ওদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৃত্যুর মুখে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে পরিচালিত মিছিলে, সড়ক অবরোধের কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ওরা থাকে মিছিলের অগ্রভাগে, বহন করে প্ল্যাকার্ড, স্লোগান দেয়। কখনও ওরা বাসে, টেম্পোতে আগুন দেয়। ঢিল ছুড়ে বাসের জানালার কাচ ভাঙে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে ঢিল ছুড়তে, পটকা-ককটেল নিক্ষেপ করতেও ওরা দ্বিধাবোধ করে না। ফলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার শিকার হতে হয় ওদের। বাংলাদেশে একের পর এক শিশুকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা চলছে হরদম। শিশু ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই শিরোনাম হচ্ছে। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত শিশুদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। পাশাপাশি শিশুশ্রম দিন দিন বেড়ে চলছে এবং বর্তমানে আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত পরিবারগুলো তাদের ছেলে এবং কন্যাশিশুকেও যে কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করছে। বাংলাদেশে মোট শিশু শ্রমিকের মধ্যে ১৩ লাখ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। দেশের শিল্প-কারখানাসহ ছোট ছোট কারখানায় নানা ধরনের কাজ করানো হয় ৮ থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুদের দিয়ে। এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে শতকরা ৯৪ ভাগ শিশু শ্রমিক কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। প্রায় ৪৭ লাখ শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুর সংখ্যা বেশি। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের প্রায় ৭৫ লাখ শ্রমজীবী শিশুর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশু সপ্তাহে ৪৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে কাজ করে থাকে। দিনে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে এরা নামমাত্র বেতন পায়। অথচ আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে শ্রমিকদের দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি খাটানো অপরাধ এবং ১৮ বছরের কম বয়সের শিশুদের দিয়ে এ ধরনের কাজ করানো সম্পূর্ণ নিষেধ। বিশ্ব শ্রমসংস্থার (আইএলও) এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৮ বছরের নিচে মোট শিশু শ্রমজীবীর সংখ্যা ৬৩ লাখ এবং এ সংখ্যা পৃথিবীর মোট শ্রমজীবী শিশুর ৫ শতাংশ। এসব শ্রমজীবী শিশু প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করে এবং এদের প্রায় অর্ধেকই কোনো মজুরি পায় না (তথ্য : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। কারখানা মালিকদের অধিক মুনাফা লাভের আশায় সেখানে চলে অমানবিক শিশুশ্রম।
দেশের শিশু শ্রমিকদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ হচ্ছে কন্যাশিশু। এরা গৃহস্থালি কাজে স্বভাবতই মাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে, যা পুত্রসন্তানরা করে না। কিন্তু কন্যাশিশুর এ ধরনের শ্রমের কোনো হিসাব করা হয় না। এর বাইরে দরিদ্র পরিবারের বেশির ভাগ কন্যাশিশুদের অন্যত্র গৃহভৃত্যের কাজে লাগানো হয়। সেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের বিনিময়ে দিনরাত খাটতে হয়। এছাড়া নির্যাতন-নিপীড়ন তো রয়েছেই। এমনকি বাড়ির পুরুষ সদস্যের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয় অনেক শিশুকে। আইএলও’র তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রতি মিনিটে বিশ্বের কোথাও না কোথাও একজন শিশু শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা আঘাতের শিকার হচ্ছে। আরও জানা যায়, বিশ্বে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি শিশু শ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি খনির কাজ থেকে শুরু করে নির্মাণ, কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের কাজে নিয়োজিত এবং বিশ্বজুড়ে শিশু শ্রমিক, বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্বে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত মোট শিশুর ৫ দশমিক ৬ শতাংশই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০১৬ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্য অর্জনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছে। শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুশ্রমকে শিশুর মানবাধিকার লংঘনের শামিল মনে করে শিশুশ্রম প্রতিরোধে গৃহীত কার্যসূচিতে ২০১৬ সালের মধ্যে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে সম্পূর্ণ বন্ধ করার কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়েছে। আইএলও’র সর্বশেষ তথ্যমতে, বিশ্বে আজ ২১৫ মিলিয়ন শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু কঠিন শ্রমে লিপ্ত রয়েছে। কাজের প্রতিকূল পরিবেশ এসব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য এনে দেয়, যা ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
শিশুশ্রম প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল করে তুলতে অবিলম্বে শিশুনীতি বাস্তবায়ন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ বন্ধ করা, আইএলও কনভেনশন ১৮২ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও ১৩৮ অনুসমর্থন করাসহ পথশিশু, ছিন্নমূল শিশু ও শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসন দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্যই মূলত শিশুশ্রমের জন্য দায়ী। সম্পদের অপ্রতুলতা, অসম বণ্টন, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব ইত্যাদি বাড়িয়ে দিচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। বেকারত্ব বাসা বাঁধছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক সুস্থ বিকাশের ধারা। শিশুশ্রম একদিকে যেমন শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সৃষ্টি করছে নানা সামাজিক সমস্যা। কন্যাশিশুদের গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্তি সৃষ্টি করছে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা। পিতৃগৃহে অভাব-অনটনের মাঝেও পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে সামান্যতম সম্ভাবনায় বেড়ে ওঠার সুযোগ থেকে হচ্ছে বঞ্চিত তারা। অন্যদিকে পরের গৃহে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত-নিপীড়ন হওয়া কন্যাশিশুরা মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর যৌন নিপীড়িত বা ধর্ষণের শিকার হলে তো কথাই নেই। বাল্যবিয়ের কারণে কন্যাশিশুরা কাটাচ্ছে এক অভিশপ্ত জীবন।
শিশু নির্যাতন বন্ধসহ সব ধরনের অন্যায়-অবিচার থেকে শিশুদের বাঁচাতে এবং শিশু অধিকার রক্ষা করতে, বিশেষ করে কন্যাশিশুরা যাতে কোনো ধরনের বঞ্চনার শিকার না হয়, তা সফল করাই কন্যাশিশু দিবস বা শিশু অধিকার সপ্তাহ পালনের মূল উদ্দেশ্য। শিল্প-কলকারখানার বিকাশ, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের প্রসার ছাড়া দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। আবার দারিদ্র্য নির্মূল ছাড়া শিশু নির্যাতন এবং শিশুশ্রমও বন্ধ করা যাবে না। কারখানায় প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়োগ নিশ্চিত করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োজিত করার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর করা প্রয়োজন। শিক্ষাবঞ্চিত নিুবিত্ত ও বিত্তহীন শিশুদের স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণদানের পর তাদের ঝুঁকিমুক্ত কাজের সংস্থানের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাল্যবিয়ে। শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রমের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করাও জরুরি। অধিকারবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সমাজের বিত্তবান ও রাষ্ট্রকে নিতে হবে। শিশুদের সব ধরনের অধিকার সংরক্ষণে সরকারকে রাখতে হবে দায়িত্বশীল ভূমিকা। শিশুরা যে একটি জাতির সঞ্চালক শক্তি, তা উপলব্ধি করতে পারলে শিশু নির্যাতন এবং শিশুশ্রম বন্ধ করা সহজ হবে। শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে রাষ্ট্র এবং সমাজের রাখতে হবে দায়িত্বশীল ভূমিকা। দরিদ্র শিশুরাই সব সময় বিত্তবানদের অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া শিশু নির্যাতন বন্ধ, শিশু অধিকার সুরক্ষা ও কন্যাশিশুদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।