ঘটনা ১: ছোট্ট রিয়ানা। স্কুলের বন্ধু অনিন্দ্য তার টিফিন কেড়ে নিয়েছে, স্কুলে তাই তারা ঝগড়া করেছে। কাঁদতে কাঁদতে মাকে এসে জানাল রিয়ানা। ব্যাপারটা আর দশটা শিশুর জীবনের সাধারণ ঘটনা হলেও রিয়ানার মা সেটা মানতে পারলেন না। তিনি কল করে বসলেন অনিন্দ্যর মাকে। ঘটনাটা আর ছোটদের ঘটনা হয়ে থাকল না।
ঘটনা ২: পঞ্চম শ্রেণির অঙ্কগুলো বেশ কঠিন মনে হয় সানার কাছে। অনেকগুলো বাড়ির কাজ, অথচ একটা অঙ্ক করতেই সানার অনেক সময় লেগে যাচ্ছিল। এদিকে সানার মা অধৈর্য হয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত উনি নিজেই করে দিলেন মেয়ের অঙ্কগুলো।
ঘটনা ৩: ঘরের কোনো কাজই সৌরভকে করতে হয় না। তার মা-বাবার একটাই কথা। ছেলে শুধু পড়ালেখা করবে। বিছানা করা, রুম গোছানো, এমনকি পানির বোতলটাও ভরে এনে দেন তার মা।
ওপরের তিনটি ঘটনার চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশ থেকে নেওয়া। সন্তান পালন করতে গিয়ে বেশির ভাগ মা-বাবাই সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সব ধরনের পরিস্থিতিতে তার সুরক্ষা, এমনকি সাফল্যও নিশ্চিত করতে চান। শিশু-কিশোরকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার এ মানসিকতাকেই হেলিকপ্টারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। একটি হেলিকপ্টারকে যেমন সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ করা লাগে, এ ধরনের প্যারেন্টিংও সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। তাই আপনার সন্তানকে যখন আপনি সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন, তখন এ অভিভাবকত্বের প্রক্রিয়াকে বলে হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং।
প্রতিটি শিশুর বিকাশের একটি পরিমাপ থাকে। আপনার শিশু বা কিশোর সন্তানটি যে বয়সে যে কাজ করতে সক্ষম, তাকে সেটি নিজ থেকে করতে দেওয়া উচিত। তবে হেলিকপ্টার প্যারেন্টস (সন্তানের বাবা–মা) সন্তানকে যে শুধু নিয়ন্ত্রণ করেন তা নয়, তাদের সামনের সব পথও বাধামুক্ত রাখতে চান। এ ধরনের মা–বাবা সন্তানদের সামনের রাস্তাটি কী হওয়া উচিত, নিজেরাই তা নির্ধারণ করে সেভাবে সন্তানকে পরিচালনা করতে চান। নিজেরা সাহায্য করে হলেও এই মা–বাবারা সন্তানকে সব সময় নিখুঁত বানানোর চেষ্টায় থাকেন।
শিশুকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন না তো?
গবেষণার তথ্য বলছে, হেলিকপ্টার প্যারেন্টিংয়ের ফলে আপনার সন্তানের ভালোর চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করলে বা তার করণীয় কাজ সহজ করে দিলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়। সব কাজে তারা মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এমনকি কোনো সমস্যায় পড়লে নিজে সেই সমস্যা থেকে বের হয়েও আসতে পারে না।
সন্তানের পরবর্তী জীবনেও এর প্রভাব পড়ে। তারা বড় হওয়ার পর শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে না। ব্যর্থতা যে জীবনেরই একটি অংশ—এ কথা তারা মানতে পারে না। কারণ, ছোটবেলা থেকে মা-বাবা তাদের সম্ভাব্য সব ব্যর্থতা থেকে আগলে রেখেছেন। এতে সন্তানটি যখন বাস্তব জীবনের নানান সমস্যার মুখোমুখি হয়, তখন সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না। এমনকি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তও নিতে পারে না।
যদিও মা-বাবা ভালোবাসা এবং সন্তানের প্রতি স্নেহ থেকে কাজটি করে থাকেন, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। আপনার কিশোর অথবা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান যখন বুঝতে পারে আপনি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছেন, তখন সে পরিবারের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা কমাতে থাকে। একটা সময় মা-বাবার সঙ্গে তার দূরত্বও বেড়ে যায়।
কীভাবে নিশ্চিত করবেন শিশুর সঠিক বিকাশ?
হেলিকপ্টার প্যারেন্টের এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য আপনার মধ্যে থাকতেই পারে। এটি নিয়ে ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। তবে আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ধীরে ধীরে এ অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে পারেন।
নিজে করতে দিন
শিশুরা কোনো কাজ করতে গেলেই বড়রা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। কখনো তাকে চিন্তা করতে না দিয়ে তাদের ওপরে আমাদের ধরাবাঁধা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিই। যেমন আকাশের রং নীল হবে, পাজলের কোন টুকরা কোথায় বসবে, অঙ্কটি কোন সূত্র দিয়ে করতে হবে—এসব আমরা সন্তানকে বারবার ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করি। এটা না করে তাদের পাশে বসে দেখুন সে কীভাবে এটি করছে। প্রথম চেষ্টাটা তাকেই করতে দিন। তারপর সে করতে না পারলে কীভাবে করতে হবে, দেখিয়ে দিন। তারপরও না পারলে নিজে করে দেখান এবং পরবর্তী কাজটা তাকে তার মতো করতে উৎসাহিত করুন।
হারতে দিন
জেতার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আমাদের সবার মধ্যে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি একটা মানুষ শিখতে পারে যখন সে ব্যর্থ হয় এবং সেখান থেকে যদি শিক্ষা নিতে পারে। নিজের সন্তান কোনো কাজ পারছে না বা হেরে যাচ্ছে, এটাকে তার বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে নিন। এ ছোট্ট হারগুলো তাকে ভবিষ্যতের জন্য আত্মবিশ্বাসী করবে। ধৈর্য বাড়াবে।
কথা বলুন, কথা শুনুন
সন্তানের সঙ্গে যত বেশি কথা বলবেন, তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন, সে তত বেশি আপনার সঙ্গে সহজভাবে যোগাযোগ করবে। সন্তানকে আদেশ না করে কোন কাজ কেন করা হচ্ছে, বুঝিয়ে বলুন। তার চাওয়া কারও ক্ষতির কারণ না হলে সেটাকে প্রাধান্য দিন। সন্তানের জেদ কমাতে এমন কিছু দেবেন না বা এমন প্রতিশ্রুতি করবেন না, যা আপনি রাখতে পারবেন না।
কাজ করতে উৎসাহিত করুন
সন্তানকে ছোটবেলা থেকে খেলনা গোছানো, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা, নিজের জুতা–মোজা গুছিয়ে রাখার মতো কাজে অনুপ্রাণিত করুন। একটু বড় হলে বিছানা-ব্যাগ গোছানো, ঘর পরিষ্কার করা, বাজার করা, রান্না করতে সাহায্য করা—এ কাজগুলো করতে দিন। এতে করে তার নিজের মধ্যে কোনো কাজ করার আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে। মা-বাবার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমবে।
প্রত্যেক মা-বাবার সন্তান পালনের নিজস্ব কিছু ধারা থাকে। কারণ, প্রত্যেক মা-বাবাই তাঁর সন্তানকে রক্ষা করতে চান, সন্তানের ভালো চান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম দিকে তাদের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আর বড় হয়ে ওঠার সময় নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে কমিয়ে দিন। কারণ, দিন শেষে সবার আগে আপনার সন্তানকে আপনার ভরসা আর বিশ্বাস করতে হবে।