ঘটনা একঃ তিন্নির দুসম্পর্কের কাকা এসেছে বাড়িতে। বাবা বসে গল্প করছেন তাঁর সাথে। তিন্নি তখনো ঘুমোচ্ছিল। মা গিয়ে তিন্নিকে জাগালো, উঠো মা, দেখো তোমার কাকা এসেছে। তিন্নি কাকাকে আগে খুব চিনত। যখন সে অনেক ছোট ছিল কাকা ওর জন্য পুতুল/চকলেট/আইস্ক্রিম কত কিছু আনত। এখন তিন্নি ক্লাস ফাইভে পরে। বলতে গেলে তিন চার বছর পর কাকা ওদের বাড়িতে এসেছে। কিন্তু ওর মধ্যে কোন উচ্ছাস নেই। ধীরে ধীরে ঘুম থেকে উঠল। মা ওকে নিয়ে গিয়ে ড্রইং রুমে কাকার কাছে নিয়ে বসালো। এত বড় হয়ে গেছো তিন্নি বলেই কাকা ওকে কোলে তুলে নিল। বাবা ভিতরে গেলেন একটু কাজ সারতে। মা রান্না ঘরে গেলেন কাকার জন্য নাস্তা তৈরি করতে। তিন্নি এখন একদম একা কাকার কাছে। খুব অসস্থি বোধ করছে। কেননা কাকা ওকে কোলে করে রেখেছে। ওর ব্যাপারটা মোটেও ভাল লাগছে না। কিছুক্ষন পরই ও বুঝতে পারল কাকা ওর গায়েও হাত দিচ্ছে। রাগে দুখে খুব অসহায় বোধ করতে থাকে ও। মা কে ডাকবে কিনা বুঝতে পারছে না। ডাকলেই বা কিভাবে কি বলবে। ওর চোখে পানি চলে এল।
ঘটনা দুইঃ ছোট্ট মেয়ে রাহা প্রতিদিন পাশের বাসার ওর বয়সী ছোট্ট একটা মেয়ের সাথে খেলতে যায়। একদিন মাকে বলে ও পাশের বাসায় গেল খেলতে। দরজা খুললেন সে বাসার কর্তা। রাহা বলল, আংকেল, মিতা বাসায় আছে? আংকেল এক মুহুর্তা ভাবলেন। তারপর খুশি হয়ে বললেন, হ্যা আছে, এসো এসো ভিতরে এসো। রাহা খুশিমনে ভিতরে ঢুঁকে গেল। এ ঘর ও ঘর খুঁজেও মিতা কিংবা আন্টি কায়কে পেল না। শুধু ওর সামনে হাসি হাসি চেহাড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আংকেল।
ঘটনা তিনঃ রাহাত ক্লাস টু এর ছাত্র। একদিন বিকেলে খেলতে বের হল বন্ধুদের সাথে। মা বারবার করে বলে দিল ঘরের সামনেই খেলবে কিন্তু, আমি কিন্তু বারান্দা দিয়ে দেখব। রাহাতরা ঠিক করল লুকুচুরি খেলবে। লুকুতে গিয়ে রাহাত একবার বারান্দার দিকে তাকালো। ওখানে মায়ের থাকার কথা কিন্তু মা নেই। সুযোগ পেয়ে লুকাতে গেল রাহাত বাসা থেকে দূরে একটি জায়গায়। লুকুচুরির চোর ওকে না দেখলেও দেখে ফেলল বিকৃত মানসিকতার দুজন ছেলে। পিছন থেকে মুখ চেপে ধরে ফেলল রাহাত কে। নিয়ে গেল কোন এক অন্ধকার ঘরে।
উপরের ঘটনা গুলো প্রতিকী হলেও বাস্তবে অহরহ ঘটছে এসব ঘটনা। আমাদের ছোট্ট শিশুটিকে ছোট্ট মনে করে অনেক কিছুতেই আমরা কিছু মনে করি না। ছেড়ে দেই তাঁকে ইচ্ছে মত। কিন্তু যা কিছু ফেস করার করে সেই ছোট্ট মনটি। কোমল মনের ওপর সেই পরা প্রভাব ক্ষতি করে ফেলে তাঁর বিশাল। আপনার পাশের বাসাটাকে আপনি কতটুকু নিরাপদ মনে করেন যে আপনার সন্তানটিকে ও ঘরে খেলতে পাঠান। হয়ত ঐ পরিবারের সাথে আপনার গলায় গলায় খাতির। তবুও কি তাদের মানসিকতা সম্পর্কে আপনি একেবারে নিশ্চিত? কি করে জানলেন যে ঐ ঘরের কর্তার মনে কোন খারাপ বাসনা নেই, যার প্রভাব পরবে না আপনার শিশুর ওপর?
আপনার আত্মীয়রা যে আপনার সন্তানকে তাঁর সন্তানের মত করেই দেখে তাঁর প্রতি আপনার আস্তা কতটুকু। তাদের হাতে একলা ছেড়ে দিতে কি আপনার মনে একবারের জন্য দুশ্চিন্তা হয় না? আপনার সন্তান আদূরে, তাঁকে অবশ্যই আপনার আত্মীয়রা আদর করার অধিকার রাখে কিন্তু কারো মনে যে কোন খারাপ কিছু নেই সে ব্যাপারে কি আপনি একদম নিশ্চিত?
আপনার সন্তান খেলতে বের হল। তাঁকে খেলতে দিয়ে যেহেতু আপনি খেয়াল রাখবেন বলেছেন তাহলে যাবতীয় সকল কাজের কথা ভুলে গিয়ে আপনার সন্তানের কথাই কি আপনার মাথায় রাখা উচিত না? আমার ছেলে সন্তান সে আবার কি বিপদে পরবে? তাঁকে নিয়ে চিন্তার কি আছে? এখনকার পৃথিবীতে সব কিছু নিয়েই চিন্তা করার আছে। ছেলে আর মেয়ে শিশু দুজনেরই একই ধরনের বিপদ হতে পারে। যা অনেক সময় আমরা খুব একটা গা করি না। যা নিয়ে ভাবি না। আমার সন্তানটি ছেলে তাই তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই অথবা আপনার ছেলে সন্তান-ই যে যৌন নিপিরণের শিকার হবে না তা কে বলতে পারে?
প্রতিবন্ধী শিশুরা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবস্থান করে সবচেয়ে বেশি রিস্ক জোনে। কেননা বিবিসি নিউজ সাউথ এশিয়ার ২০১০ সালের একটি স্টাডি মতে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ৭-১৮ বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫২% মেয়ে ও ৪৮% ছেলে শিশুরা এই নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধীদের সংখ্যাই বেশি। এই রিসার্চ টি করে Bangladesh Protibondhi Foundation (BPF) and Save the Children Sweden-Denmark.
২০১১ সালের অগাস্ট মাসে ডেইলি স্টারের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ৬.৬% ছেলে এবং ১৫.৩% মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় পরিবারের বন্ধু, শিক্ষক, আত্মীয়, পরিচিত ব্যাক্তিদের দ্বারা। ৯-১৭ বছর বয়সী প্রায় ৫৮১ জন শিশুদের নিয়ে তৈরি এই রিসার্চটি করা হয় ঢাকাসহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও সীতাকুন্ড জেলার ওপর।
২০১১ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক বিবৃতিতে দেখা যায়, আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু ধর্ষণ। রিপোর্তে দেখা যায় বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানায়, ছয় মাসে ধর্ষণ ১৩৮ জন শিশু। ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩৮ জন শিশু, এর মধ্যে শুধু জুনেই ধর্ষণের শিকার ২৬ জন। এদের মধ্যে এককভাবে ২১ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে তিনজন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ।
গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ সালে দৈনিক সংগ্রামে “নজিরবিহীন মানবাধিকার লংঘন : বিপর্যস্ত বাংলাদেশ-৪” শিরোনামের এক রিপোর্টে দেখা যায় ৪৭ মাসে দেশে ৫২৮১ নারী-শিশু হত্যা ধর্ষণ নির্যাতনের শিকার।
নতুন বছর ২০১৩ এ গত বছরের সরেজমিনে দেখা গেছে খুলনায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫৪৩টি।
দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। আর তাই মা-বাবার একটু সচেতনতা ছেলে মেয়েকে অনেক ক্ষেত্রে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করে। ছোট্ট বলে সন্তানের ব্যাপারে হালকা ভাবে চিন্তা করতে নেই। আপনার সন্তান জন্ম থেকে গড়ে ওঠুক একটি সুস্থ পরিবেশে সেটা নিশ্চিত করা আপনারই দ্বায়িত্ব। কোন যৌন বিকৃত মন যাতে তাঁকে স্পর্শ করতে না পারে। যেদিন থেকে আপনি একটি সন্তানের মা-বাবা হবেন সেদিন থেকেই আপনার দ্বায়িত্ব তাঁর জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা। অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, তাই বলে আমি কি আমার আত্মীয়দেরকেও বিশ্বাস করব না। আপনার বিশ্বস্থ নিকট আত্মীয় ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করার খুব কি দরকার আছে?
মা-বাবার একটু সচেতনতা নিশ্চিত করতে পারে আপনার সন্তানের সঠিক মানসিক গঠন। সন্তানরা হয়তো সব সময় সব কিছু মুখ ফুটে বলে না, মাঝে মাঝে হয়তো বলতে লজ্জা পায় আপনার মেয়ের অথবা আপনার মেয়ের মন বুঝতে পারার ক্ষমতা তৈরি করে নিতে হবে আপনাকে। তাঁর কি সমস্যা হচ্ছে কিংবা হয়েছে তা যদি মা-বাবা হয়েও না বুঝতে পারেন তবে তাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করারটা হয়ে পড়বে অনেক কঠিন। সবচেয়ে ভাল হয় আপনার সন্তানের সাথে আপনার বন্ধুত্বপূর্ন আচরন করাটা। বন্ধুর মত করে নিজের সন্তান সম্পর্কে জানা এবং তাঁকে কিছু ব্যাপার জানানো। যাতে করে সে আপনাকে মন খুলে বলতে পারে তাঁর কি সমস্যা, কি ভাল লাগে কি ভাল লাগে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটি কথা মনে রাখা জরুরী, সন্তানের মনের ওপর যদি একটুখানিও বিকৃত মনের প্রভাব পড়ে তবে ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে আপনার স্বপ্ন, আপনার আশা, আপনার সোনামনির ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা। ইদানিং পত্রিকা খুললেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা চোখে পড়ে অহরহ। এখনি সময় সচেতনতার।
আপনি যদি মা কিংবা বাবা না হন, যদি বড় ভাই কিংবা বোন হন কিংবা হন পরিবারের অন্য কোন সদস্য তবে মা-বাবার পাশাপাশি পরিবারের শিশুটির প্রতি আপনারও কিন্তু দ্বায়িত্ব রয়েছে, তাঁর মানসিক গঠনে কোন বাধা যেন দিতে না পারে কোন বিকৃত মনের মানুষ, তাঁর সুন্দর আগামী যেন গড়ে না উঠে ভয়ে আতঙ্কে।