ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু :::
‘আজকের শিশু আগামীর পরিপূর্ণ নাগরিক’, ‘আজকের শিশুরাই আগামীতে জাতির কর্ণধার’, ‘ভবিষ্যতে আজকের শিশুরাই দেশ-জাতির নেতৃত্ব দিবে’—এমন সব কথাবার্তা বিভিন্ন সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের শিশুদের সামগ্রিক চিত্র ভয়াবহ। এদেশে শিশু শ্রমিকের সঠিক সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী এদেশে প্রায় এক কোটিরও অধিক শিশুশ্রমিক কর্মরত। এসব শিশুশ্রমিকরা শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় শিশুশ্রমিক হিসেবে কর্মরত। এরা প্রতিনিয়ত শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে এবং জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য শিশুশ্রমের মত কঠিন শ্রমকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। এ দেশে ৬-১০ বছরের মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ শিশুর মধ্যে স্কুলে যায় মাত্র ৫০ ভাগের মত। এদের মধ্যে আবার শতকরা ৩৫ ভাগ শিশুই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করে দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে স্কুল ছেড়ে দেয়। আবার দেশের অনেক শিশু দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে কখনোই স্কুলে যায় না। তাছাড়া দেশে ছিন্নমূল শিশুর সংখ্যা প্রায় কয়েক লাখের মতো। এদের শতকরা ৫০ ভাগেরই নিজস্ব কোন ঠিকানা নেই। এদের সংখ্যা বেশি দেখা যায় রাজধানী ঢাকা শহর তথা দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরে। আবার দেশে পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশুর সংখ্যাও কম নয়। দারিদ্র্যসহ পিতা-মাতার অসচেতনতার কারণে অনেক শিশুই শিকার হচ্ছে অপুষ্টির। এসব অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর অনেকেই শেষ পর্যন্ত শিশুশ্রমে আত্মনিয়োগ করতে দেখা যায়। আর বর্তমান সময়ে শিশুদেরকে নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যেমন: মাদক চোরাচালান, চুরি, ছিনতাইয়ের কাজে নিয়োজিত করাসহ রাজনৈতিক মাঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এক পক্ষ কর্তৃক আরেক পক্ষের ওপর অস্ত্র ছুঁড়তে, বোমা-গ্রেনেড-পেট্রোল মারতে, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে ইত্যাদি যা রীতিমতো দুঃখজনক বিষয়।
এবারে আসা যাক শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে যে শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন এবং শিশু অপহরণের ঘটনা শিশুশ্রমের মতোই যে নাটকীয়ভাবে বেড়ে চলছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং পত্রিকার পাতা খুললেই কিংবা টেলিভিশনের সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে এ বিষয়ক সংবাদ। অবৈধভাবে অর্থ আদায় বা মুক্তিপণ, পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য, পিতা বা মাতা কর্তৃক পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়া, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাসহ মা-বাবার সম্পর্কের জটিলতাসহ নানা কারণে এদেশে শিশুহত্যার মতো জঘন্য ও ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার সুদ্রাটিকি গ্রামের চারশিশু হত্যার মাধ্যমে এবং রংপুরের মিঠাপুকুর এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা থেকে তিনটি শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনার মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের শুরু থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এদেশে সাড়ে ৯শ’রও বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ২০৯টি, ২০১৩ সালে ২১৮টি এবং ২০১৪ সালে ৩৫০টি শিশু খুনের ঘটনা ঘটে। আর গতবছরের অর্থাত্ ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত শিশুখুনের ঘটনা ঘটে ১৯১টি। দেশে প্রতিনিয়ত শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন এবং শিশু অপহরণের মতো বেদনাদায়ক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও যেন কারো টনক নড়ছে না। পাশাপাশি এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিংবা পেশীশক্তির জোরে অনেক সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে একদিকে যেমন সামাজিক অবক্ষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি অপরদিকে তা সার্বিক সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার পরিচয়ই তুলে ধরে। শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন এবং শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে আগামীতে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশে শিশুশ্রম বন্ধে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সরকার, জনগণ, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সচেতন প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত অধিকারবঞ্চিত শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে তাদের পাশে দাঁড়ানো। অপরদিকে শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িতদেরকে ‘মানবতার শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদেরকে যেকোন মূল্যে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজনে এসব জঘন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে বিচারের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নসহ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন। পাশাপশি তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলাও আবশ্যক। অন্যথায়, আজকের শিশুদের পক্ষে আগামীদিনের ভবিষ্যত্ হয়ে ওঠা একদিকে যেমন সম্ভবপর হবে না তেমনি অপরদিকে প্রতিটি শিশু থাকবে অনিরাপদ আর প্রতিটি ঘর হবে অশান্তির নীড়—যা কখনো কারো কাম্য নয়।
লেখক :অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
ই-মেইল: kekbabu@yahoo.com
সংগ্রহিত – দৈনিক ইত্তেফাক