( শরীফ আবদুল গোফরান ) : নাম তার নজরুল। যাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। এ কথাটি বললে তোমাদের মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না। বোঝারও বাকি থাকে না কে সেই নজরুল।
শিশুদের জন্য রচনার ক্ষেত্রে নজরুল ছিলেন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ এবং তোমরা যারা শিশু তাদের প্রিয় বন্ধু। ফলে নজরুলের ছড়া, কবিতা, গান ও নাটিকার কিছু অংশ তোমাদের মত ছোট্ট বন্ধুদের ভাবনায় উৎসারিত।
নজরুলের শিশু পাঠ্য হলো-পুতুলের বিয়ে (নাটিকা ও কবিতা), ঝিঙেফুল (কবিতা), সাতভাই চম্পা (কবিতা), সঞ্চায়ন (কবিতা), মক্তব সাহিত্য (পাঠ্যবই), ঝড় (কবিতা ও গদ্যের কিছু সংকলন), পিলে পটকা, ঘুম জাগানো পাখি (কবিতা) এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো কিছু শিশু সংগীত আর রচনাবলী নিয়েই কবি নজরুলের শিশু সাহিত্য। তাঁর “শিশু সাহিত্যে” গল্প উপন্যাস বা প্রবন্ধ নেই। নজরুল মূলত কবি ও গীতিকার। ফলে তাঁর শিশুদের জন্য রচনা ছড়া, কবিতা ও গানেই সীমাবদ্ধ। তিনি সর্বপ্রথম শিশুদের মনোরঞ্জক কবিতা লিখেন “লিচুচোর”।
বাবুদের তাল পুুকুরে
হাবুদের ভাল কুকুরে।
নজরুলের বয়স যখন মাত্র ২০/২২ বছর তখন থেকেই শিশু রচনায় নতুন উৎসাহে তোমরা যারা ছোট তাদের জন্য কবিতা, ছড়া লেখায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন, কবি কিশোর বয়সে লেটোর দলে যাবার সময়ও লিখেছেন। তবে তা তোমাদের জন্য নয়।
কবি নজরুলের তোমাদের জন্য রচনাকে মূলতঃ দু’ভাগে ভাগ করতে পারে। যেমন ধরো-নিতান্ত খোকা-খুকুদের প্রাণ পাঠ্য-পুস্তক ধর্মী কিশোর রচনা, প্রথমটিতে আছে সহজ সরল কথায় হাস্য কৌতুক, রং তামাসা, ব্যাংগ-বিদ্রƒপ, ফূর্তি, মনমাতানো ছেল- ভোলানো রচনা। দ্বিতীয়টিতে স্কুল পাঠ্য কিছুটা কঠিন ভাষায় কিশোর-কিশোরীদের জীবন গঠনের কথা।
কবি নজরুলের বাল্যের লোকজীবন চর্চায় প্রভাব পরবর্তীকালে তার শিশু-কিশোর রচনাবলীতে ওতপ্রোতভাবে ছায়া ফেলেছে। তাছাড়া শিশু সাহিত্যে নজরুল পল্লীকে স্মরণ করেছেন, ঘুম পাড়ানী গান গেয়েছেন। জোনাকী, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালী, কাজলদীঘি, পদ্মফুল, গাংপাখী, ফুল, মাঠ, চাঁদ, ঝুমকোলতা, ঝিঁঝিপোকা, শুকতারা স্থান পেয়েছে নজরুলের শিশু সাহিত্যে। আর এসব শিশুর হাসি উজ্জ্বল ঝর্না।
শিশু সাহিত্যে নজরুল সার্থক। কারণ তিনি শিশুকে শিশুর মতো, কিশোরকে তার বয়সোচিত পরিম-লে ছোটদের স্বকীয় ভুবনে অরূপ জগতের সন্ধান নিয়ে সংগী করতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি একজন সার্থক শিশু সাহিত্যিক। নজরুল সৃষ্টি করলেন, পিলে পটকা, থোঁদল কুতকুত, মটকু মাইতি, বাটকুলরায়, ঠ্যাংফুলী, উটমুখো, সুঁচকো-হাশিম ইত্যাদি। তোমাদের জন্য লেখা কবি নজরুলের হাস্যরস প্রবণ কবিতা রচনাতে যেন নজরুল প্রতিভা অধিক সার্থক।
নজরুলের ব্যাঙ্গাত্মক ও রূপকথাশ্রয়ী কৌতুক তরুণ শিশু কবিতাগুলো অতি বাস্তব, জীবন্ত, উজ্জ্বল ও শিশুদের একান্ত নিজস্ব রসে টইটম্বুর।
যেমন-
ভোর হলো দোর খোল
খুকুমনি ওঠরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে
ফুল পাখি ছুটরে।
তা ছাড়া আরো দেখো
“আমি হবো সকাল বেলার পাখী-
সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি”।
অথবা
আমি যদি বাবা হতুম
বাবা হত খোকা
না হলে তার নামতা পড়া
মারতাম মাথায় টোকা”।
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন তোমাদের মত ছোট্ট বন্ধুদের আপনজন। “জাগো সুন্দর চির কিশোর”, নাটিকায় নজরুলের কিশোর সাগর অভিযান শেষে মুক্তোমানিক আনার স্বপ্ন দেখে, চাঁদের দেশে গিয়ে পৃথিবীতে অমৃত আনবে শিশুরা। কবি নজুলের অগ্নিশিশু পড়লে দেখবে নজরুলের হাস্য রসিক কবিতা। যেমন
“মা, খাবার কথা বলি যদি
ভাববি পেটুক ছেলে,
আমি ভাত না খেয়েও থাকতে পারি
পোলাও লুচি পেলে।”
তারপর দেখো
“ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়
যাইতে যাইতে খ্যাঁচ খ্যাঁচায়।
প্যাঁচায় গিয়া উঠলো গাছ,
কাওয়ারা সব লইল পাছ।”
কবি নজরুল তো তোমাদের প্রিয় মানুষ প্রিয় বন্ধু। এতো প্রিয় মানুষটি কি তাঁর প্রিয় ছোট্ট বন্ধুদের না ডেকে পারে? না, মোটেও পারে না। এ জন্যই তো তিনি সারা জনম ধরে তোমাদের ডেকেই গেছেন, যেমন-
“তুমি নও শিশু দুর্বল
তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার; বিপুল বিরাট
অমৃতের সন্তান”।
কবি নজরুল তোমাদের ভালবাসতেন বলেই তো তোমাদের নিয়ে ভাবতেন। তিনি পল্লী কবি জসীমউদ্দীনকে তোমাদের মতো ছোট্ট বন্ধুদের কথা বলতে গিয়ে এক চিঠিতে লিখেন
আমি দখিনা হাওয়া। ফুল ফুটিয়ে যাওয়া আমার কাজ। তোমাদের মতো শিশু কুসুমগুলোকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চলে যাবো।
বন্ধুরা কবি নজরুল আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৪ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন দূরে বহু দূরে। যেখান থেকে আর কোনদিন তিনি ফিরে আসবেন না। কিন্তু আমরা যদি তার রেখে যাওয়া সাহিত্যের সাথে পরিচিত হই তা হলে আমরা জীবন্ত নজরুলকেই আমাদের মাঝে পাবো। ফলে তাঁর সাহিত্য যতদিন বেঁচে থাকবে তিনিও ততোদিন বেঁচে থাকবেন সকল পাঠকের হৃদয়ে হৃদয়ে।