জন্ম নাম ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র ( জন্ম ১৭ জানুয়ারি ১৯৪২ মৃত্যু ৩ জুন ২০১৬) একজন মার্কিন পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, সাধারণভাবে যাকে ক্রীড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেভিওয়েট হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ক্রীড়াজীবনের শুরুর দিকে আলী রিংয়ের ভেতরে ও বাইরে একজন অনুপ্রেরণাদায়ক ও বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাঁকে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় ও বিবিসি তাঁকে শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত করেছে।
প্রথম জীবন মুহাম্মদ আলী জানুয়ারি ১৭, ১৯৪২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির লুইভিলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্লে সিনিয়র সাইনবোর্ড এবং বিলবোর্ড রঙ করতেন এবং মা ওডিসা গ্র্যাডি ক্লে একজন গৃহিনী ছিলেন। দুই ভাইয়ের বড় ক্লের নামকরণ তাঁর পিতা ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে সিনিয়রের নামে করা হয়, যার নাম একই নামের একজন উনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন রাজনীতিবিদের সম্মানে রাখা হয়েছিল। ক্লের পিতামহ ও পিতামহীর নাম ছিল জন ক্লে ও সালি অ্যানা ক্লে। ক্লের ভগিনী ইভার বয়ান অনুযায়ী সালি মাদাগাস্কারের অধিবাসী ছিলেন। সিনিয়র ক্লে প্রাক-গৃহযুদ্ধের দক্ষিণাংশের একজন আফ্রিকান আমেরিকান ক্রীতদাসের বংশধর ছিলেন।
লুইভিলার পুলিস অফিসার তথা বক্সিং প্রশিক্ষক জো মার্টিন ক্লেকে প্রথম বক্সিং শিখতে বলেন,যখন তিনি বারো বছরের ক্লেকে একজন সাইকেল চোরের সঙ্গে মারপিট করতে দেখেন। এর পরবর্তী চার বছর বক্সিং কাটম্যান চাক বোডাক তাঁকে প্রশিক্ষণ দেন।
১৯৬০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ক্লে
ক্লে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় নামেন। তিনি ছয়বার কেন্টাকি গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি, দুইবার জাতীয় গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি, একবার অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ইউনিয়ন জাতীয় উপাধি এবং রোমে অনুষ্ঠিত ১৯৬০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে বক্সিং প্রতিযোগিতায় লাইট হেভিওয়েট বিভাগে স্বর্ণপদক লাভ করেন। অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় ক্লে ১০০ বার জেতেন ও মাত্র পাঁচ বার পরাজিত হন।
পেশাদার বক্সিং
প্রথমদিকের লড়াই
ক্লে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে অক্টোবর পেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় প্রথম বারের জন্য অংশ নেন এবং টানি হানসাকারকে ছয় রাউন্ডে পরাজিত করেন। বাসন মাজা ও ঝাঁট দেওয়ার মত কাজ করতে অস্বীকৃত হয়ে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ক্লে তাঁর প্রশিক্ষক আর্চি মুরকে ত্যাগ করেন। এরপর তিনি অ্যাঞ্জেলো ডান্ডিকে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। এই সময় তিনি সুগার রে রবিনসনকে ম্যানেজার হিসেবে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন।
এরপর থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধ পর্যন্ত ক্লে ১৯-০ জয়ের রেকর্ড করেন যার মধ্যে ১৫টি জয় নকআউটের মাধ্যমে ঘটে। এই সময় তিনি টনি এস্পার্তি, জিম রবিনসন, ডনি ফ্লীম্যান, আলোঞ্জো জনসন, জর্জ লোগান, উইলি বেসমানফ, ল্যামার ক্লার্ক, ডগ জোন্স, হেনরি কুপার ইত্যাদি মুষ্টিযোদ্ধাদের পরাজিত করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ক্লে আর্চি মুরকেও পরাজিত করেন। প্রথম দিককার এই লড়াইগুলিতে ক্লেকে বেশ কয়েক বার সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। হেনরি কুপারের সঙ্গে লড়াইয়ে ক্লে চতুর্থ রাউন্ডে কুপারের হুকে মাটিতে পড়ে যান, কিন্তু সঠিক সময়ে ঘন্টার আওয়াজে বেঁচে যান। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই মার্চ নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ডগ জোন্সের সঙ্গে লড়াই এই সময় তাঁর জীবনের কঠিনতম লড়াই ছিল। প্রতিটি লড়াইয়ের শুরুতে ক্লে তাঁর প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন ও নিজের ক্ষমতার দম্ভ করতেন। তাঁর এই আচরণ বহু দর্শকদের মনে ক্রোধের সঞ্চার করত।
ক্যাসিয়াস ক্লে হলেন মোহাম্মদ আলি
শিরোপা জয় করার পর তিনি দ্রুত খ্যাতির শীর্ষে পৌছে যান। এ সময় তিনি ঘোষনা দেন তিনি নেশন অফ মুসলিম গোত্রের সদস্য। তার নাম রাখা হয় ক্যাসিয়াস এক্স, কারণ তিনি মনে করতেন তার পদবী দাসত্বের পরিচায়ক। এর কিছুদিন পর গোত্র প্রধান সাংবাদিকদের কাছে তাকে মোহাম্মদ আলি বলে পরিচয় করিয়ে দেন| কথিত আছে তিনি সুন্নী সুফি শায়খ হিশাম কাব্বানীর হাতে মুরিদ হন.
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকার
১৯৬৪ সালে তিনি সৈনিক জীবনে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হন পরীক্ষায় অনুত্তীর্ন হয়ার কারনে। ১৯৬৬ সালে তিনি উত্তীর্ন হন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে কোরআন যুদ্ধ সমর্থন করে না। আল্লাহ বা নবীর নির্দেশ ছাড়া তিনি যুদ্ধে যাবেন না। কোন ভিয়েতকং এর সাথে তার বিরোধ নেই, তারা কেউ তাকে কালো বলে গালিও দেয়নি। তিনি ক্যাসিয়াস ক্লে বলে পরিচিত হতে চাননি, এ কারনে তিনি ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় লড়াই এ অংশ নিতে পারেননি।
১৯৬৫ সালে লিস্টন এর সাথে ফিরতি ম্যাচের পর ১৯৬৭ সালে যরা ফলির সাথে ম্যাচের মধ্যে তিনি ৯ বার শিরোপা রক্ষার লড়াইএ নামেন। খুব কম বক্সারই এত কম সময়ে এত বেশি বার লড়াই করেন। তার জীবনের একটি অন্যতঅম কঠিন লড়াইএ তিনি ১২ রাউন্ডে জয় লাভ করেন। আলি ১৯৬৬ সালে আমিরিকায় ফিরে এসে ক্লিভলান্ড উইলিয়ামস এর সাথে লড়াই করেন। এটি তার সেরা ম্যাচগুলোর একটি যেটিতে তিনি ৩ রাউন্ডে জিতেন। ১৯৬৭ সালে তিনি হিউস্টন এর একটি রিং এ এরনি তেরেল এর সাথে ল্রড়াই এ নামেন। তেরেল তাকে ম্যাচ এর আগে ক্লে বলে অপমান করেন। আলি তাকে সঠিক শাস্তি দেয়ার মনস্থির করেন। ১৫ রাউণ্ডের এ লড়াইএ তিনি তাকে রক্তাক্ত করেন, অনেকে মনে করেন যে আলি ইচ্ছা করে লড়াই আগে শেষ করেননি। ১৯৬৭ সালে তিনি ৩ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন যুদ্ধে না যাওয়ার কারনে। ১৯৭০ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি লড়াইএ ফিরে আসতে সমর্থ হন।
শতাব্দীর সেরা লড়াই মার্চ ১৯৭১ সালে আলি জো ফ্রেজিয়ারের মুখোমুখি হন যা ‘শতাব্দীর সেরা লড়াই’ হিসাবে পরিচিত। বহুল আলোচিত এ লড়াইটি ছিলো দুই মহাবীরের লড়াই যা সকলকে শিহরিত করে। জো ফ্রেজিয়ার খেলায় জয়লাভ করেন ও আলি প্রথমবারের মত পরাজিত হন। ১৯৭৪ সালের ফিরতি লড়াইয়ে তিনি অবশ্য শিরোপা পুণরুদ্ধার করেন।
রাম্বেল ইন দ্যা জাংগল
তিনি ১৯৭৪ সালের অক্টোবারে জর্জ ফোরম্যান এর সাথে লড়াই এ নামেন যা রাম্বেল ইন দ্যা জাংগল বলে পরিচিত। আলির ঘোর সমর্থকরাও এতে আলির সম্ভাবনাদেখেননি। ফোরম্যান ও নর্টন আলির সাথে প্রবলভাবে লড়াই করেন ও জর্জ তাদের ২ রাউণ্ডে পরাজিত করেন। ফোরম্যান ৪০ টির মধ্যে ৩৭ টি লড়াই নকআউটে জিতেন ৩ রাঊণ্ডের মধ্যে। আলি এ ব্যাপারটিকে কাজে লাগাতে চাইলেন। সবাই ভেবেছিলো তিনি ক্ষিপ্রতার সাথে লড়াই করবেন, কিন্তু তিনি দূরে দূরে থাকতে লাগলেন। ফোরম্যানকে তিনি আক্রমণ করতে আমন্ত্রন করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তাকে ক্লান্ত করে দেয়া। ৮ম রাউন্ডে তিনি তার সুযোগ পেয়ে গেলেন ও ফোরম্যানকে নকআউট করলেন।
ইসলাম গ্রহণ
১৯৭৫ সালে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার মতে এ জন্য ভুমিকা রাখেন নেশন অফ মুসলিম এর প্রধান ডব্লু. ডি. মুহাম্মদ।
১৯৭৫ সালে আলি লড়াই করেন ফ্রেজিয়ার এর সাথে। দুজন বীরের এ লড়াইএর জন্য সকলে খুবই উত্তেজিত ছিল। ১৪ রাউণ্ডের শেষে ফ্রেজিয়ার এর কোচ তাকে আর লড়াই করতে দেননি কারণ তার এক চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফ্রেজিয়ার এর কিছুদিন পরই অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের এক লড়াইএ তিনি ১৯৭৬ এর অলিম্পিক মেডালিস্ট লিয়ন স্পিংক্স এর কাছে খেতাব হারান। তিনিই প্রথম যিনি একজন অপেশাদার এর কাছে হেরেছিলেন। ১৯৭৯ তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
অবসর গ্রহণ
তবে তিনি ১৯৮০ সালে ফিরে আসেন ল্যারি হোমস এর কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিতে। ল্যারি ছিলেন তার শিষ্য তাই সকলেই লড়াইটি নিয়ে আগ্রহী ছিল। ১১ রাউন্ড পর আলি পরাজিত হন। পরে জানা যায় মস্তিস্কে মারাত্বক ত্রুটি ধরা পরেছে। তার মস্তিষ্ক ফুটো হয়ে গিয়েছিল। পরে তিনি ১৯৮১ সালে অবসর গ্রহণ করেন(৫৬ জয় ৩৭টি নকআউটে ৫ পরাজয়)। তিনি “সর্বকালের সেরা” বক্সার।
আলীর বাংলাদেশ সফর
১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি বিদেশি সংস্থা ৫ দিনের সফরে তাকে ঢাকায় এনেছিল। সে সময় তার সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ওই সময়ের বিখ্যাত মডেল ভেরোনিকা পরশে, মেয়ে লায়লা আলী, ভাই, বাবা ও মা। একবার কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম পদকজয়ী বক্সার আবদুল হালিম একই রিংয়ে নেমেছিলেন। তবে সেদিন আবদুল হালিমকে নকআউট করেননি তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী। তিনি আরও ছোট কাউকে চেয়েছিলেন তার সাথে মজা করার জন্য,তখন বাংলাদেশের জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ১২ বছর বয়সী গিয়াস উদ্দিন তার সাথে বক্সিং খেলার সুযোগ পান। সেই সফরে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মান সূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়ামকে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়।
শেষ কথা ১৯৮০ সালে তিনি পারকিন্সন্স রোগে আক্রান্ত হন। তাকে যখন বলা হয় তিনি তার রোগের জন্য বক্সিংকে দায়ী করেন কিনা, তিনি বলেন বক্সিং না করলে এত বিখ্যাত হতেন না। অবসরের পরে তিনি তার জীবনকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ৩২ বছর পারকিনসন্স রোগে ভোগার পর ০৩ জুন, ২০১৬ তে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি।