এখন শীত। এই সময়ে শীত পড়বে, মানুষ শীত অনুভব করবে এটাই স্বাভাবিক। ঋতু পরিক্রমায় বছরের এই সময় শীত নির্ধারিত। আমাদের দেশ গ্রাম প্রধান, গ্রামে শীতের কিছু সাধারণ দৃশ্য আছে। খেজুর গাছের রস পাড়ার দৃশ্য, এটা এক অদ্ভুত চিত্র, অনেক কষ্ট করে খেজুর গাছের একটি অংশ কর্তন করে, নল দিয়ে সেখান থেকে রস পড়ে, এই রস হাটে বাজারে বিক্রি হয়, মানুষ খুব উপভোগ্য হিসেবে এটাকে ক্রয় করে খায়, আমাদের সংস্কৃতিতে শীতের পিঠাপুলি এবং খেজুর গুড় খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবয়বে অবস্থান করছে।
শীতের সন্ধ্যা আর শীতের সকাল নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে, এ নিয়ে প্রবন্ধ, কবিতা, ছোটগল্পের অভাব নেই। শিশির ভেজা শীতের সকাল তার মধ্যে পায়ে হাটা এতে রয়েছে আলাদা ছন্দ, চাদর মুড়ো দিয়ে শীতের সকাল দিনে ঘুরে দেখেননি তিনি বাঙালি হলেও বাঙলার স্বাদ আস্বাদন তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। শীতের সন্ধ্যা পশ্চিমের আকাশের এক অদ্ভুত চরিত্র, এদেশের মানুষ যেকোন পশ্চিমা দেশে অবস্থান করুক না কেন সভ্যতার যত আলো বাতাস অবলোকন করুক না কেন আমাদের এই অদ্ভুত স্বকীয় সৌন্দর্যে যিনি অভিষিক্ত হননি তার বাংলা ভাষাভাষি হওয়ার স্বার্থকতা খুবই কম। আমাদের গাং পাড়, আমাদের খাল পাড়, আমাদের শর্ষেক্ষেত, নারিকেল গাছ, পুদিনা পাতা এগুলিই বাংলাদেশ, বড় বড় অট্রালিকা আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ আমাদের প্রতিভূ নয়। শীতের সকালে ফেলুন দিয়ে মাছ ধরা অথবা খালের মধ্যে দিয়ে কৌষা নৌকার চলন আবহমান বাংলার সহজ সরল প্রকৃতির প্রকাশ। আমি পাঠকদেরকে বিনীত নিবেদন করব এগুলি দেখার জন্য। কুঁড়ে ঘরের বাইরে বাড়ির ঢালে চাদর মোড়ানো শীশুরা খই মুড়ির পাত্র নিয়ে প্রথম সূর্য প্রহরে যে আনন্দের ব্রেকফাস্ট করে তা দেখার জানিনা কয়জনের সৌভাগ্য হয়েছে তবে আমার মনে হয় গ্রাম প্রধান এ দেশের শতকরা আশি ভাগ লোক গ্রামে বাস করে ফলে শীতের কিচ্ছা কাহিনীতে এগুলির গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
শীতের মৌসুমে পুকুর সেঁচে মাছ ধরার একটি রীতি রয়েছে গ্রাম অঞ্চলে, ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায় কারণ বর্ষায় এই মাছগুলি পুকুরে এসে জমা হয়। শীতের মাছ ধরা, শীতের ধান কাটা এগুলি নিয়ে কত যে লোকসাহিত্য আছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। আমাদের শীতের আপ্যায়ন জগত বিখ্যাত ঘটনার মধ্যে একটি, গ্রামে হোক, শহরে হোক শীতে পিঠা ফিরনি তৈরী হয় না এমন কোন ঘর বাড়ি নেই।
আমাদের গ্রামসমূহে মেজবানি মেহমানদারী শীতে হয় পিঠা পুলি দিয়ে, কত যে রকমারি পিঠা আর কত যে আলপনা, কত যে বাহারী রূপ পিঠার মধ্যে প্রকাশ পায়, জামাই আদর, নাতিন আদর, নায়রি আদর সবকিছুই হয় এই পিঠার মাধ্যমে। একেবারে গ্রামের গরীব কৃষকও শুধু আপ্যায়নের জন্য ফসলের একটি অংশ পিঠার গুড়া করে, পিঠা বানায় পিঠা খায়। শহরের রাস্তার পাশেও বাফাপিঠা, চিতল পিঠা শীতের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীত কিছুটা স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, শীতের আকার আকৃতি ও দৈর্ঘ্য প্রকৃতি কিছুটা পরিবর্তিত হচ্ছে। শীতের প্রভাব বা কনকনে ভাব কিছুটা হ্রাস বৃদ্ধি হচ্ছে। তবে শীত শীতই কারণ এটি একটি আমাদের জন্য বিশেষ সময়, আমাদের সাহিত্য আমাদের সংস্কৃতিতে শীত অনবদ্য এবং আবহমান। আমি শীত নিয়ে লিখতে বসে মনে হয়েছে শীতের পরিধান কি হবে, কি ধরনের কসমেটিক্স ব্যবহার করা যায়, কোন মার্কেটে গেলে উন্নত শীতবস্ত্র পাওয়া যায়, শীতে আপনার ত্বক কীভাবে সুন্দর ও কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এগুলো নিয়ে লিখব না বলবও না। আমাদের গণমাধ্যম, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিজ্ঞাপনী সংস্থা এগুলি নিয়ে অনেক বলাবলি করছে, লোভনীয় ও চমকপ্রদভাবে ব্যানার ফেস্টুন এগুলি প্রদর্শন করেছে। আমি দীর্ঘদিন ঢাকার বাহিরে ছিলাম, জন্ম ও কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকার সুযোগ হয়েছে এই আলোকে মনে হয়েছে বাংলার সাধারণ মানুষ শীত কীভাবে অনুভব করে তাই লিখব। শীতে আমরা চাদর মুড়ো দেই, শহবে সাহেবেরা শীতে স্যুট কোট পড়ে কিন্তু বাঙালিদের এগুলি খুব মানায় না সুযোগ পেলেই খুলে ফেলে কারণ আমাদেরকে কাজ করতে হয় আমাদের নিজস্বতায়। শীতে মানুষের কাজের সময় কিছুটা পরিবর্তিত হয়, বিরূপ আবহাওয়া থাকলে খেটে খাওয়া মানুষের কাজও অনেক সময় বন্ধ থাকে। প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ বা সাথে অন্য কোন দুর্যোগ না হলে শীত আমাদের জন্য আনন্দেরই।
ড. মির শাহ আলম,
পরিচালক (শিক্ষা)
বাংলাদেশ বেতার, সদর দপ্তর, ঢাকা