সিলেটে বন্যা: কমছে পানি, বেড়েছে দুর্ভোগ

সিলেটের নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখনো বিপদসীমার ওপরে রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় দুর্ভোগ এখনো কমেনি। বন্যাকবলিত জেলা ও মহানগরের ২০ লক্ষাধিক লোকজন নানান ভোগান্তিতে আছেন। বিদ্যুৎহীনতা আর বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। এখন পর্যন্ত মহানগরীর কোথাও ত্রাণ বিতরণ করেনি সিসিক। ফলে নগরীর নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো ত্রাণ পায়নি। তাদের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান থাকলেও তুলনামূলকভাবে কম ত্রাণ বরাদ্দের অভিযোগ উঠেছে। জেলার অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি। শনিবার সকালে ত্রাণের জন্য পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতিও হয়েছে জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়।

চলতি মাসের ১১ তারিখ থেকে ভারিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা পানিবন্দি হওয়ার পর ১৬ মে থেকে সুরমার পানি উপচে নগরেও পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এক এক করে নগরীর বেশির ভাগ ওয়ার্ডের লোকজন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর জেলার শতাধিক ইউনিয়নের মধ্যে ৯০টি ইউনিয়নপ্লাবিত হয়। এক এক করে সড়ক থেকে বাসাবাড়ি, সরকারি স্থাপনা, দোকানপাট থেকে শুরু করে সব জায়গায় বন্যার পানি ঢুকতে থাকে। ফলে সর্বত্র সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। শত কোটি টাকা ড্রেনেজ নেটওয়ার্কে ব্যয়ে করেও বন্যা দেয়া যায়নি। মানুষজন আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও কেন্দ্রগুলোর নিচতলা ডুবে বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েন। ইতোমধ্যেই খাবারের অভাব, বিশুদ্ধ পানির হাহাকার, বিদ্যুৎহীনতা, চরম দুর্ভোগ আর সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন পানিবন্দি মানুষ। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হলেও নগরে এর ছিটেফোঁটা নেই।

নগরের তেররতন এলাকায় দিনমজুর শাহ আলম স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। তিনি বলেন, ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু বন্যায় তার পরিবারের সব পাল্টে দিয়েছে। ঘরে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে মালামাল। রান্নাবান্না বন্ধ। খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

একই এলাকার বাসিন্দা সাথী বেগম বলেন, কত কষ্টে আমরা আছি- একটু দেখে যান। পারলে একটু সাহায্য করেন।

ঘাশিটুলা এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, আমাদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট পাঁচ দিন পানিতে ডুবে ছিল। এখন পানি কমছে। তাই পানি দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছি। সারাদিন এসব করে চলে গেছে।

ছড়ারপাড় এলাকায় কাদির মিয়ার কলোনিতে বসবাসকারী দিনমজুর আবদুল কুদ্দুস বলেন, আগে কাজকর্ম করতাম। বন্যায় সব ডুবে গেছে- কাজ নেই। কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে।

তাদের মতো অনেকেই বলছেন, এখন পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশন থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা হয়নি। তবে প্রাপ্ত বরাদ্দ খুবই কম থাকায় কারো মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি বলে জানান সিসিকের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান।

তিনি বলেন, আমাদের যা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে- তা খুবই কম। তাই আমরা বিতরণ করিনি। বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলে মেয়র সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বিতরণ কার্যক্রম শুরু করব। ইতোমধ্যে আমরা সংশ্লিষ্টদের আমাদের চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।

এদিকে, সিলেট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার ১১টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিনশ’ মেট্রিক টন চাল, নগদ ২৫ লাখ টাকা ও চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার লাছুখাল গ্রামের জুহুরা বেগম বলেন, থানা বাজার মন্ত্রী ত্রাণ দিতে শুনে কমর পানি ভেঙে এসেছিলাম, কিন্তু ত্রাণ পাইনি। ত্রাণ না পেয়ে খেয়েছি মাইর।

শিলেরভাঙ্গা গ্রামের সালাম বলেন, ঘরে চাল নাই। মন্ত্রী ত্রাণ দেবেন শুনে এসেছি। ত্রাণ পাইনি। খালি হাতে বাড়ি যাব।বাচ্চাদের কি দেব- সেই চিন্তায় আছি।

গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলং এলাকার বাসিন্দা নূর ইসলাম বলেন, ঘরে পানি। রান্না করতে পারছে না। সন্তানদের নিয়ে খুব বিপদে আছি। কোন সহায়তা এখনও পাইনি।

অপরদিকে, বন্যায় জেলার ৭ শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

সিলেটের সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস পেয়েছে। সুরমা নদীর পানি শুক্রবারের চেয়ে শনিবার দুটি পয়েন্ট কমেছে। কুশিয়ারার পানি দুটি পয়েন্টে বাড়লেও কমেছে দুটি পয়েন্টে। লোভা, সারি ও ধলাই নদীর পানি কমেছে।

কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ১৩.৬৭ মিটার ; শনিবার বিকাল ৩টায় ১৩.৫৮ মিটার। এ নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে শুক্রবার ছিল ১১.০৯ মিটার; শনিবার বিকাল ৩টায় হয়েছে ১০.৯৭ মিটার। সুরমার এই দুই পয়েন্টে পানি কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে।

কুশিয়ারা নদীর আমলশিদ পয়েন্টে শুক্রবার সন্ধ্যায় ছিল ১৭.০৫ মিটার, শনিবার বিকাল ৩টায় পানিসীমা দাঁড়ায় ১৬.৯১ মিটার। এ নদীর পানি কমেছে শেওলা পয়েন্টেও। এখানে শুক্রবার ছিল ১৩.৬৩ মিটার; শনিবার বিকাল ৩টায় হয় ১৩.৫৯ মিটার। এখনো এ নদীর দুই পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর শেরপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বেড়েছে। শেরপুরে শুক্রবার পানিসীমা ছিল ৭.৮১ মিটার; শনিবার সকালে ৭.৯৪ মিটার। ফেঞ্চুগঞ্জে শুক্রবার ছিল ৯.৭৩ মিটার; শনিবার বিকালে বেড়ে হয়েছে ৯.৮৩ মিটার।

লোভা নদীর পানি শুক্রবার সন্ধ্যায় ছিল ১৪.০০ মিটার। শনিবার বিকালে কমে হয়েছে ১৩.৮৬ মিটার। সারি নদীর পানি শুক্রবার সন্ধ্যায় ১১.৪৪ মিটার থাকলেও শনিবারে বিকালে কমে হয়েছে ১০.৯১ মিটার।

এ ছাড়া ধলাই নদীর পানিও কমেছে। এ নদীর পানিসীমা শুক্রবার ছিল ১০.৮৮ মিটার; শনিবার বিকালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১০.৬৬ মিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, পানি কমতে শুরু করলেও সুরমা, কুশিয়ারায় এখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। পানি কমার ধারা অব্যাহত থাকলে দু-একদিনের মধ্যেই বিপৎসীমার নিচে নেমে যাবে পানি।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ার সাদাত বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আমরা আমাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম প্রতিদিনই অব্যাহত রাখছি। কোথাও ত্রাণের সংকট দেখা দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

 

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *