উঠানো পানি উঠি গেছে। চুলাও ডুইবা গেছে। আম্মায় রানতা পাররা না। একটু আগে বিস্কুট খাইছি। স্কুল বন্ধ। পানি। খেলাতও যাইতা পাররাম না। দুই দিন থাকি ভাই আর আমার জ্বর উঠছে।’ ঘরের বারান্দায় বসে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এভাবেই গতকাল শুক্রবার কথাগুলো বলেছে ছয় বছরের তাহিয়া আক্তার।
তাহিয়া আক্তারের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার পশ্চিমদর্শা গ্রামে। সে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তার মা শিল্পী আক্তার (২৫) বলেন, বন্যার পানিতে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো তাঁর দুই শিশু সন্তানও ঘরবন্দী। উঠানে পানি, তারা ঘরের বাইরে গিয়ে খেলাধুলাও করতে পারছে না। তালহা হাসান নামে তাঁর দুই বছরের ছেলে আছে। দুই সন্তানই জ্বরে কাবু বলে তিনি জানান।
বানভাসি মানুষ বলছেন, সিলেটে চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে বাড়ির শিশুদের। পানিতে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে প্রায় সব অভিভাবকই শিশুদের বাড়ির বাইরে যেতে দিচ্ছেন না। যাঁদেব বাড়িতে পানি উঠেছে, সেসব পরিবার শিশুদের খাট থেকে নামতে দিচ্ছেন না। সপ্তাহখানেক ধরে তারা ঘরবন্দী। এ কারণে অনেক শিশু হাঁপিয়ে উঠেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সুরমা নদীর পানি উপচে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিমদর্শা, পূর্বদর্শা, অনন্তপুর, বাদিয়ালী, মেদিনীমহল ও বাছিরপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পানি উঠেছে। এই ছয় গ্রামে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে অন্তত এক থেকে দেড় হাজারই শিশু। এসব শিশুর বেশির ভাগই স্কুলগামী। কেউ কেউ আবার শিশুশ্রমে নিযুক্ত। এখন সবাই পানিবন্দী হয়ে ঘরের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অনেক শিশু জ্বর-সর্দিসহ পানিবাহিত নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন।
বাদিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা মাসুক মিয়া (৫০) বলেন, পানিতে সবাই ঘরবন্দী। শিশুরাও সারা দিন বিছানার ওপর থাকে। উঠানে পানি, ঘরেও পানি। শিশুরা একদিন পানিতে নামলে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের জ্বর এসে যায়। পানিতে ময়লা থাকায় অনেক শিশুর শরীরে চর্মরোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। পানি উঠে পড়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের ভালো কিছু খাওয়াতেও পারছেন না। প্রাপ্তবয়স্করা শুকনো খাবার টানা খেতে পারলেও শিশুদের চিড়া-বিস্কুট খাইয়ে কত দিন রাখা যেতে পারে, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। অথচ চুলা ডুবে যাওয়ায় অনেক পরিবারে শুকনো খাবারই এখন ভরসা।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সোনিয়া আক্তার (১২) পড়াশোনা করে মেদিনীমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার বাড়ি বাদিয়ালী গ্রামে। তার ছোট বোন নুসরাত জাহানের বয়স সাড়ে তিন বছর। সোনিয়াদের ঘরেও হাঁটুসমান পানি। রান্নাঘর তলিয়ে গেছে। নানার বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার মাঝেমধ্যে তাদের দিয়ে যায়। বন্যায় তাই এক বেলা খেয়েই তাদের থাকতে হচ্ছে।
একাধিক শিশুর অভিভাবক বলেন, ঘরে-বাইরে পানি থাকায় শিশুদের ঘরবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে। অনেক শিশু পানি দেখে প্রথমে উচ্ছ্বসিত হলেও বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এখন তারা ভড়কে গেছে। কমে গেছে আগের দুরন্তপনা।
সিলেট শহরে কখনো দিনমজুর, আবার কখনো রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ মেটান বাদিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা বশির আহমদ (৩২)। তাঁর প্রায় এক বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। বাড়িতে পানি উঠে পড়ায় স্ত্রী ও মেয়েকে তিনি পাশের টুকেরবাজার এলাকার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। বশির প্রথম আলোকে বলেন, পানি আসায় তাঁর আয়রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। সঞ্চয় ভেঙে এত দিন চলেছেন। এখন হাতে টাকা নেই। তাই মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলছেন। খাবারসংকটে দুর্ভোগে আছেন তাঁরা। একমাত্র মেয়েটাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।