ক্রিকেটে নারীদের জাতীয় দল তখন ছিল না। থাকার কথাও নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই যে তখন হাাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা। ২৩ বছর আগে দেশের মানুষের অনেক আনন্দ আর গৌরবের উপলক্ষ হয়ে আমিনুল ইসলাম, আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীনরা গেলেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে। তৃতীয় ম্যাচেই বাজিমাত। স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ পেয়ে গেল বিশ্বকাপে প্রথম জয়। লক্ষ্যপূরণের আনন্দের মধ্যেই বড় গৌরব। শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকেও হারায় বাংলাদেশ। উৎসবে মেতে উঠল গোটা দেশ।
২৩ বছর আগের সেই মুহূর্তগুলোই যেন আজ হ্যামিল্টনে নতুন করে মঞ্চায়িত হলো। এবার ইতিহাস গড়লেন নারীরা। ছেলেদের মতোই প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে এসে তৃতীয় ম্যাচেই তুলে নিলেন জয়। এবার অবশ্য স্কটল্যান্ড নয়, প্রতিপক্ষের নাম পাকিস্তান। ছেলেরা যেমন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম কোনো টেস্ট দলের বিপক্ষে জয়ের গৌরব গায়ে মেখেছিল, মেয়েরা দুই যুগ পর সেই পাকিস্তানকে হারিয়েই বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের ইতিহাস গড়ল।
পাকিস্তানের বিপক্ষে আজকের এই জয়টি এক প্রকার প্রত্যাশিতই ছিল। মেয়েদের চেনা প্রতিপক্ষ বলেই হয়তো। এই পাকিস্তানকে শেষ ওভারের এক রোমাঞ্চেই তো বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে হারিয়েছিলেন নিগার সুলতানা–ফারজানা হক–রুমানা আহমেদ–সালমা খাতুনরা। এই পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ তিন ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে মেয়েরা। কিন্তু আজ হ্যামিল্টনের জয়টির সঙ্গে তুলনীয় নয় কিছুই। এই জয় যে বিশ্বকাপের মঞ্চে, বিশ্ব আসরে এই জয়ের মহিমাই বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে অনন্য। এ জয় যে এ দেশের নারী ক্রিকেটে নতুন দিনের শুরুর ইঙ্গিত দেয়।
গত নভেম্বরে ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হয়েছিল জিম্বাবুয়েতে। শুরুটা ছিল দারুণ। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে চূড়ান্তপর্বের টিকিট কাটতে বাছাইপর্বের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি বাংলাদেশকে। র্যাঙ্কিং বিবেচনাতেই প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে যায় বাংলাদেশের মেয়েরা। বাছাইপর্বে পাকিস্তানকে হারালেও থাইল্যান্ডের কাছে হেরে কাজটা কিছুটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত করোনা ‘সৌভাগ্য’ হয়েই আসে দলের জন্য।
যেভাবেই হোক, নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলাটা ছিল মেয়েদের জন্য আরাধ্য এক বিষয়। দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের একজন জাহানারা আলম কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, ‘এবার খেলতে না পারলে আবার ২০২৬ পর্যন্ত অপেক্ষা। ততদিন খেলতে পারব কি না, কে জানে!’
জাহানারা কিংবা সালমাদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের অপেক্ষা বাড়েনি। শুধু তা–ই নয়, ক্যারিয়ার শেষ করার আগে বিশ্বকাপে জয়টাও দেখে যেতে পারছেন তাঁরা। ইতিহাসের অংশ হতে পারার সৌভাগ্য কজনের হয়!
বাংলাদেশের মেয়েদের বিশ্বকাপযাত্রা গত এক দশকের অনেক ত্যাগ, ক্রিকেটারদের নিবেদন ও পরিশ্রমের ফল। আজ পাকিস্তানকে হারিয়ে দলের অপেক্ষাকৃত নবীন ক্রিকেটাররা যখন আনন্দ–উল্লাস করছেন, তখন ড্রেসিং রুমের এক কোণায় বসে সালমা–জাহানারাদের চোখ যদি বারবার ভিজে ওঠে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। দেশের নারী ক্রিকেটের দুই পথপ্রদর্শক আজ ড্রেসিংরুমে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সেই সংগ্রামী দিনগুলোকে নিশ্চয়ই মনে করবেন। নবীনদের নিশ্চয়ই তাঁরা স্মরণ করিয়ে দেবেন, বিশ্বকাপের প্রথম জয়টি যেমন অনেক পরিশ্রমের ফসল, ঠিক তেমনি এই জয়টি দেশের নারী ক্রিকেটকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শুরুর দায়িত্বও এনে দেয়। নতুনদের দায়িত্বের শুরুটা এখান থেকেই।
অধিনায়ক নিগার সুলতানা বিশ্বকাপে পা রেখেই প্রত্যয়ী ছিলেন। প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তিনি দেশের মানুষকে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার কথা বলেছিলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সেটি হয়নি। খুব কাছে গিয়েও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে হারই হয়েছে সঙ্গী। তৃতীয় ম্যাচে এসেই নিগার সুলতানা দেখা পেয়েছেন সেই ‘ভালো কিছু’র, আরাধ্য জয়ের। অনেক কষ্টে পাওয়া সুযোগটা দারুণভাবেই কাজে লাগিয়েছেন তাঁরা।
নারী ক্রিকেটের চেহারাটা বদলে গিয়েছিল ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জয়ের পরপরই। মানুষের আগ্রহ বেড়েছে এর পর। এর আগে মেয়েরা ক্রিকেট খেলে—এই ধারণাই বা কয়জনের ছিল সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু এশিয়া কাপ জেতার পর নারী ক্রিকেট নিয়ে সকলের ধারণা বদলে দিতে সক্ষম হন নারী ক্রিকেটাররা। আরও বড় স্বপ্ন দেখার শুরু সেখান থেকেই। সেই স্বপ্নের একটি ধাপ আজ অতিক্রম করলেন মেয়েরা।
অধিনায়ক সুলতানা আরও একটি কথা শুরুতে বলেছিলেন,‘ওয়ানডে বিশ্বকাপ আমাদের জন্য বিরাট এক সুযোগ। দল হিসেবে এখানে আমরা নিজেদের সামর্থ্যটা বুঝতে পারব। সেই সামর্থ্য সবার সামনে প্রমাণ করতে পারব। সবাইকে দেখাতে পারব দল হিসেবে আমরা কতটা উন্নতি করেছি।’
ওয়ানডে বিশ্বকাপ প্রমাণ করে দিয়েছে মেয়েদের সামর্থ্যের ব্যাপারটি। এবার কেবল এগিয়ে যাওয়ার পালা। নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পালা। সুন্দর একটা ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর পালা।
লেখক: নাইর ইকবাল – দৈনিক প্রথম আলো