নিজের টেনশনের কথা চেপে না রেখে বরং ভাগ করে নিন ছেলেমেয়ের সঙ্গে। ওদের ভরসা জিততে গেলে ওদের বন্ধু হয়ে উঠুন।

মনটা আজকাল ভাল থাকে না সায়ন্তনীর। অফিসে মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করার পরেও যদি অফিস পলিটিক্সের শিকার হতে হয়, কারই বা মন ভাল থাকে? বাড়িতেও প্রিয়ম এসব কথা শোনায় আগ্রহ দেখান না সেভাবে। তিনি নিজের অফিস, বন্ধুবান্ধব নিয়েই ব্যস্ত, স্ত্রীয়ের সমস্যার ভাগ নেওয়ার জন্য খুব একটা সময় তাঁর হাতে থাকে না। আর মেয়ে নিকিতা তো নেহাতই ছোট, সবে ক্লাস এইট। তার সঙ্গে আর এসব কী আলোচনা করবেন সায়ন্তনী? ওই মেয়েকে নিয়েও হয়েছে তাঁর আর-এক জ্বালা। একটু বড় হওয়ার পর থেকে কারা যে মেয়ের বন্ধু, কাদের সঙ্গে সে মেশে… কিছুই আর বলে না মা’কে। আগে কত গল্প করত! এখন যে শেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছে নিকিতা, তাতেই বিপদে পড়েছেন সায়ন্তনী। মেয়েকে বোঝাতেও গিয়েছিলেন যে মায়ের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা উচিত। সপাট জবাব দিয়েছে মেয়ে, “তুমি আমার সঙ্গে সব শেয়ার করো?”

মুশকিলটা এখানেই। অনেক মা-বাবাই ভাবেন, ছেলেমেয়ে নেহাতই ছোট। নিজেদের কোনও কথা ওদের সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। আবার আশা করেন, সন্তান এসে নিজেদের সব কথা বলবে তাঁদের। এমন একতরফা তো হয় না ব্যাপারটা! ওদের ভরসা পেতে গেলে আপনি যে ওদের ভরসা করেন, সেটা বুঝতে দিতে হবে।

আপনি হয়তো ভাবছেন, ‘ভরসা করি না, কে বলল? কিন্তু নিজেদের সমস্যাগুলোর কথা ওদের বলে কী হবে? ওদের মনখারাপ হবে কেবল’। আপনার দিক থেকে দেখতে গেলে, খুব ভুল ভাবনাও নয়। মা-বাবারা তো চানই, যতদিন সম্ভব ছেলেমেয়েকে আগলে রাখতে। কোনও সমস্যা, কোনও কষ্টের আঁচ যাতে ওদের গায়ে না লাগে, তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু জানেন কি, ওদের পৃথিবীটাও শুধুই হাসি-গান-আলো দিয়ে ভরা নয়? ওদেরও সমস্যা রয়েছে, যন্ত্রণা রয়েছে? সেগুলো হয়তো আমাদের বড়দের কাছে তেমন কিছু নয়, ওদের কাছে কিন্তু অনেকটাই! নিজেদের মতো করে সেগুলো সামলানোও ওদের কাছে যুদ্ধেরই মতো। সেই যুদ্ধে আপনাকে ওরা তখনই সঙ্গী করবে, যদি আপনিও নিজের লড়াইয়ে ওকে শামিল করেন।

খুব বিরাট কিছু করতে হবে না। জাস্ট বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়ের সঙ্গে খোলামনে গল্প করুন। সারাদিন কী কী হল, শেয়ার করুন। যদি কোনও সমস্যা হয়ে থাকে, সে কথাও। কী বলবেন, কতটা বলবেন, সেটা একান্তই আপনার উপর। অবশ্যই খুব জটিল কোন বিষয়ের ভার ওর উপর চাপিয়ে দেবেন না। কিন্তু ছোটখাটো সমস্যা বা কেউ আপনার কাজে অসুবিধা করছে… এ রকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। একেবারে ছোটদের কথা বলছি না, বুঝতেই পারছেন। স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে পড়ে, এমন বাচ্চাদের মধ্যে কিন্তু এগুলো বোঝার পরিণতিবোধ চলে আসে। তাদেরও কি আর ক্লাসে এরকম ছেলেমেয়ে থাকে না? এতে করে প্রথমত ওরা আপনাদের সঙ্গে নিজেদের রিলেট করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, বুঝতে পারবে যে বাবা-মা ওকে বাচ্চা ভাবে না। গুরুত্ব দেয়। এই বিশ্বাসটা ওদের মধ্যে তৈরি হওয়া মানেই আপনিও ওর বিশ্বাস জিতে নিলেন!

আগেই বলেছি, আপনার সন্তানও কিন্তু নিজের দুনিয়ায় নিজের মতো করে সমস্যা সামলায়। ফলে আপনার অনেক মুশকিলের সমাধান কিন্তু ও-ও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দিতে পারে। ধরুন অফিসে কেউ বিনা কারণে গসিপ করে আপনাকে নিয়ে। কিংবা কেউ অযথাই পেশাদারিত্বের গণ্ডি ডিঙিয়ে বেশি বন্ধুত্ব করতে চায় আপনার সঙ্গে। কাছাকাছি পরিস্থিতি হয়তো আপনার সন্তানের সঙ্গেও হয় ওর স্কুল বা কলেজে! তখন ও কী করে তা সামলায়? সেখান থেকেই হয়তো আপনিও কিছু ইনপুট পেয়ে গেলেন! তবে অবশ্যই সমস্যার গুরুত্ব বুঝে তা নিয়ে কথা বলুন।

শুধু সমস্যার কথাই শেয়ার করবেন না নিশ্চয়ই। অফিসে আপনার যাঁরা বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে গল্প করুন। কোনও চ্যালেঞ্জিং কাজের দায়িত্ব কীভাবে সামলান, সেই ঘটনা শেয়ার করুন। হালকা গসিপও চলতে পারে অবশ্যই। তবে কখনওই ঠাট্টার ছলেও অন্য কারও ব্যাপারে অসম্মানজনক মন্তব্য করবেন না। ওরাও কিন্তু তাহলে সেটাকেই ‘কুল’ ভেবে নেবে!

ছেলেমেয়ের কাছ থেকে ওদের সারাদিনের কথাও জানতে চান। জানতে চাওয়ার মতো করে নয় কিন্তু। গল্পচ্ছলে। খুব কঠিনও হবে না ব্যাপারটা। আপনি যখনই ওদের সঙ্গে খোলামনে গল্প করবেন, ওরাও দেখবেন তা-ই করবে! নিজেদের জীবনের হাসি-মজার গল্পগুলোর পাশাপাশি সমস্যার কথাও ভাগ করে নেবে আপনার সঙ্গে। সকলে মিলে সমাধানের পথ খুঁজে বের করাও খুব কঠিন হবে না!

তবে একটা জিনিস মাথায় রাখুন। সব বয়সের মানুষেরই নিজস্ব স্পেস লাগে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা আরওই সত্যি। ওদের সেই স্পেসকে সম্মান করুন। যদি কোনও কথা ওরা বলতে না চায়, জোর করবেন না। ওদের সমস্যায় নিজেরা জড়িয়ে পড়বেন না। পথ দেখিয়ে দিন দরকার হলে, কিন্তু সামলাতে দিন ওদেরকেই। এগুলো জীবনের খুব জরুরি পাঠ। তবে কোনও ব্যাপারে যদি ওরা আপনাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য চায়, সে কথা আলাদা। তখন তো পাশে থাকতেই হবে!

মোট কথা একটাই। ছেলেমেয়েদের আর ছোট না ভেবে, বন্ধুর মতো করে মিশুন ওদের সঙ্গে। অনেক লাভ হবে তাতে। ওরা আপনাকে বিশ্বাস করবে। নিজেদের কথা আপনার সঙ্গে ভাগ করে নেবে। আর আপনারও ছোট-বড় সমস্যায় হয়তো নিজেদের মতো করে দিশা দেখাতে পারবে!

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *