সন্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মেটাতে চাইলে সন্তানকে স্বাধীনতা দিন। তবে অবাধ স্বাধীনতা নয়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানকে বড় করে তোলার সময় বাবা-মায়ের সবদিকে লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন অভিভাবক হিসেবে বাবা-মায়ের দায়িত্ব সন্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। এখানে সন্তানকে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করার দায়িত্বও আপনারই। কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি বুঝতে পারছেন যে, সন্তানের আপনাকে আর অতটা প্রয়োজন হচ্ছে না, তা মেনে নেওয়া মুশকিল।
ক্লাস ফাইভের শিশু বাড়ি ফিরে স্কুলের সব ঘটনা মাকে যেভাবে বলে, একজন কিশোর বা কিশোরী কিন্তু তা বলে না। এ ধাক্কা মায়ের প্রতিদিন লাগে। মায়েদের বুঝতে হবে, সন্তানকে নির্ভরশীল নয়, স্বাধীন করে তোলাই হওয়া উচিত প্যারেন্টিং-এর লক্ষ্য।
ছোটবেলায় বাবা- মা সন্তানকে দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে স্কিল গড়ে তোলা, সবই শেখান। কিন্তু টিনএজ সন্তানদের ক্ষেত্রে ‘কথা কম শোনা বেশি’ জরুরি। কারণ এসময় তার নিজস্ব এক সত্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে, ওদের বলতে দিন, আপনি শুনুন বেশি।
প্রত্যেক সম্পর্কেই একটা গণ্ডি আছে। বয়ঃসন্ধির সন্তানের সঙ্গে নিজের বাউন্ডারি সেট করে নিন। এখনও অনেক শিশু বাবা-মায়ের সঙ্গে শোয়। এটা কিন্তু মোটেও কাম্য নয়। পাঁচ-ছয় বছর বয়সের পর আলাদা শুতে দিলেই ভাল। মায়েরা সচেতনভাবে সন্তানের ডায়েরি, ফোন, চিঠি পড়বেন না। এ ছোটখাট বিষয়গুলো কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মা বা বাবা সন্তানের কাছে রোল মডেল। মা যা করছেন সেটির ব্যাপারে বললে বা সন্তানকে সেই কাজটি করতে বললে দ্বন্দ্ব অনেক কমে। যেমন ধরুন, আপনি চান যে সন্তান বই পড়ুক। অথচ আপনি নিজে বই পড়েন না। এমনটা করলে কিন্তু সন্তান আপনার কাছ থেকে শিখবে না।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রত্যাশা বা এক্সপেক্টেশন। অনেক সময় নিজেদের মধ্যে আলোচনা না করেই সন্তানের উপর প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেন মা-বাবা। একইসঙ্গে পিয়ার প্রেশারও রয়েছে। হয়তো, কোনও ছেলে সন্তান বড় হয়ে মেক-আপ আর্টিস্ট হতে চায়! কিন্তু মা মেনে নিতে পারেন না, তিনি হয়তো তাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অফিসার হিসেবে দেখতে চান। এটা কিন্তু মায়ের নিজস্ব ক্রাইসিস, তার ইচ্ছেগুলো তিনি সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে চান।
প্রশংসা করাও জরুরি। সন্তান যখন প্রথম হাঁটতে শিখল, মা হয়তো প্রচুর ছবি তুলে রাখলেন। কিন্তু আপনার টিনএজ সন্তানের কোন কাজেরও কি ঠিক সেভাবে প্রশংসা করেন? রি-ইনফোর্সমেন্ট বিষয়টা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। আই কনট্যাক্ট করে সন্তানের প্রশংসা করুন। নিয়মিত যদি মা-বাবারা সন্তানের ভাল গুণগুলো তাকে বলেন, তাহলে ও বুঝবে যে মা-বাবা তার কাজ লক্ষ্য করেন। এ ধরনের গঠনমূলক অ্যাটেনশন সম্পর্ক আরও মজবুত করবে।
মনে রাখতে হবে, মা-ও কিন্তু একজন রক্তমাংসের মানুষ। তিনিও ভুল করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সন্তানের কাছে গিয়ে ‘সরি’ বলতেই পারেন। যেমন ধরুন, আপনি হয়তো আপনার টিনএজ সন্তানের ঘরে ঢোকার আগে দরজায় নক করে ঢোকেন। একদিন যদি তা করতে ভুলে যান, তাহলে তার কাছে অকপটে ‘সরি’ বলতে ক্ষতি কি! এতে সন্তানও বুঝবে যে আপনি দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে নন। মায়ের উপরও চাপ থাকে যে তাকে ‘গুড মাদারিং’ দিতে হবে, তথাকথিত ‘ভাল মা’ হয়ে উঠতে হবে। সন্তানের কাছ থেকেও কিন্তু মা শেখেন।
কিছুটা সময় শুধু পরিবারের জন্য রাখা প্রয়োজন। সারাদিনের কাজের শেষে যদি খানিকটা সময় ফ্যামিলি টাইম হিসেবে কাটানো যায়, তা বাবা- মা-সন্তানের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে। হয়তো ডিনার একসঙ্গে খেলেন। টিভি বা ফোন দেখতে দেখতে খাবেন না। বরং, সন্তানের মুখের অভিব্যক্তিকে লক্ষ্য করুন। ফ্যামিলি মিল হলো কথোপকথনের জায়গা। প্রত্যেককে বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। অনেক অভিভাবকই শোনেন কম, দ্রুত সিদ্ধান্তে চলে আসেন। জাজমেন্টাল হবেন না। কারণ, আপনি যদি জাজমেন্টাল না হন, তাহলেই সন্তান আপনার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশবে।
ওয়ান-টু-ওয়ান টাইম খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক টিনএজারের বাবা-মায়েরা খুব ব্যস্ত। অনেকটা সময় না দিতে পারলেও অসুবিধে নেই। সারাদিনে এক কাপ কফি নিয়ে খানিকক্ষণ নাহয় সন্তানের সঙ্গে বসলেন, প্রতিদিন এরকম কিছু মুহূর্ত নিয়ম করে কাটানো জরুরি।
সন্তানকে বাড়ির কাজে ইনভলভ করুন। তাকে বোঝানো জরুরি যে সে পরিবারে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমি বাবা-মায়ের কাজে লাগছি’, এ বোধটা বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীদেরদের আত্মবিশ্বাস জোগায়। আপনার বাড়ির নিয়ম বা সীমাবদ্ধতা কী কী, তা সন্তানকে প্রথমেই বোঝানো প্রয়োজন। তাহলে ও বুঝতে পারবে ওর থেকে বাকিদের কী প্রত্যাশা বা ওর কতটা ছাড় আছে। হয়তো একদিন ও ভুল সময়ে বেরুতে চাইল বা অন্যদিন দেরি করে ফিরল, এরকম বিষয়গুলো নিয়ে মনোমালিন্য এড়িয়ে চলতে চাইলে ঠান্ডা মাথায় ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
কথা বেলার সময় আই কনট্যাক্ট জরুরি। আপনি সবজি কাটতে কাটতে তাকে জিজ্ঞেস করছেন, স্কুলে কী হলো! তাহলে সে আপনাকে না-ও বলতে পারে। বিশেষত কোন সেনসিটিভ বিষয় হলে সন্তানের মুখের দিকে তাকালেই অনেককিছু বুঝতে পারবেন।
সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে সন্তানের কোন ক্রাইসিস হলে, বাবা-মা প্যানিকড হয়ে যান। এখানেও কোন দ্বন্দ্বের জায়গা তৈরি হতে পারে। এ বিষয়গুলোতে কেয়ারফুল হতে হলে নিজেকে প্রয়োজনে ট্রেইনড হতে হবে।
সন্তানের শিক্ষার জন্য খরচ করতে অভিভাবকরা যেমন আপোষহীন হয়ে থাকেন, সন্তানের মানসিক সাপোর্টের বিষয়টিতেও তেমনই হতে হবে। কারণ এটা আপনার সন্তানের সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সমান জরুরি।
লেখক:সামিয়া আলম
প্যারেন্টিং কোচ, রিলেশনশিপ কাউন্সেলর, ডিপ্রেশন অ্যান্ড ট্রমা স্পেশালিস্ট