চলতি মৌসুমের করোনাকালীন সমস্যার সাথে সংযুক্ত হয়েছে আরও একটি ভাইরাসজনিত রোগ ডেঙ্গু। বাংলাদেশের মৌসুমী বৃষ্টিপাতে সাথে সাথেই বাড়তে দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। বড়দের সাথে একইভাবে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরাও। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আক্রান্ত অর্ধেক জনসংখ্যায়ই শিশু। এ অবস্থায় আমাদের জেনে নেয়া উচিত কিভাবে ডেঙ্গু ছড়ায়, আক্রান্ত রোগের উপসর্গ, ডেঙ্গুর নিরাময় ও সতর্কতা। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক ডেঙ্গু কি ও কিভাবে ছড়ায়।
ডেঙ্গু (DEN-gee) জ্বর একটি মশা দ্বারা বাহিত রোগ। এটির ভাইরাস সারা শরীরে ব্যথা, জ্বর, মাথাব্যথা সৃষ্টি করে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি টাইপের যেকোনো একটি দিয়ে ডেঙ্গু রোগ হয়ে থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রাথমিকভাবে এডিস মশা দ্বারা পরিবাহিত হয়, স্ত্রী মশা ডেঙ্গু আক্রান্তর রক্তপান করে নিজে সংক্রমিত হয় ও পেটে ভাইরাস বহন করে। প্রায় ৮-১০ দিন পর ভাইরাস মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে যার মধ্যে আছে মশার লালাগ্রন্থি। সারা জীবনের জন্য আক্রান্ত হলেও মশার উপর এই ভাইরাসের কোন ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে না। এডিস ইজিপ্টি কৃত্রিম জলাধারে ডিম পাড়তে, মানুষের সবচেয়ে কাছে থাকতে এবং অন্যান্য মেরুদন্ডীদের চাইতে মানুষের রক্ত খেতে বেশি পছন্দ করে। যখন একটি এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন মশা ভাইরাসের বাহক হয়ে উঠে। যদি এই মশা অন্য কাউকে কামড়ায়, সেই ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। ভাইরাসটি একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সরাসরি ছড়াতে পারে না।
এবার জেনে নেয়া যাক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগের উপসর্গ সমূহ। সংক্রামিত মশার কামড়ের ৪ দিন থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত যে কোন উপসর্গ শুরু হতে পারে এবং সাধারণত জ্বর ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত থাকে। উচ্চ জ্বর (যেমন ১০৫°F), চোখের পিছনে এবং জয়েন্ট, পেশী/অথবা হাড়ের মধ্যে ব্যথা, প্রচন্ড মাথাব্যথা, শরীরের বেশিরভাগ অংশে ফুসকুড়ি, নাক বা মাড়ি থেকে অল্প ঘষাতেই রক্তপাতের মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। হাড় এবং পেশীর ব্যথার কারনে ডেঙ্গু জ্বরকে “ব্রেকবোন ফিভার” ও বলা হয়ে থাকে। এ জ্বর আসলে কোনো হাড় ভাঙ্গে না, কিন্তু ব্যাথার তীব্রতার জন্যে এটা মনে হয়।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা অন্য জ্বরের মতই করতে হবে। বর্তমান মৌসুমে শিশুর জ্বর শুরু হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। নির্দিষ্ট মাত্রার প্যারাসিটামল দেওয়া, হালকা গরম পানিতে শরীর মুছে দেয়া, বেশি বেশি তরল খাবার রোগীকে খাওয়াতে হবে। যেসব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হল – তরল খাবার, পানি, খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত, স্যুপ ইত্যাদি বেশি করে পান করাতে হবে মুখে যত পারা যায়। প্রস্রাব যথেষ্ট ও ঠিকমতো করছে কি না, খেয়াল রাখা আর ছয় ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না হলে হাসপাতালে নিতে হবে। কোনো বাচ্চার জ্বর ৫-৬ দিন পার হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে চলে যায় এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যদি কারো রোগ গুরুতর আকার ধারণ করে, অথবা জ্বর চলে যাওয়ার পর প্রথম বা দুই দিনের মধ্যে লক্ষণগুলি আরও খারাপ হয়ে যায়, অবিলম্বে চিকিৎসা সেবা নিতে হবে।
ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্যে নিম্নে কয়েকটি পদক্ষেপ সবার নেয়া উচিত। মশার বংশবৃদ্ধির জায়গা দেবেন না। তারা পানিতে ডিম পাড়ে, তাই পাত্রে এবং ফেলে দেওয়া টায়ারের মতো জমে থাকা পানি থেকে মুক্তি পান এবং সপ্তাহে অন্তত একবার পাখির বাথ, কুকুরের বাটি এবং ফুলের ফুলদানিতে র করতে ভুলবেন না। শুধুমাত্র বাসার আশেপাশেই নয় বরং সম্পূর্ণ এলাকায় পানি না জমে থাকে সে দিকে নজর রাখুন, এর জন্য আপনি আপনার প্রতিবেশীদের সাথে একজোট হয়ে কাজে নামতে পারেন। মশার ঔষধ ব্যবহার করা জরুরি। বিপুল ও বিস্তৃত রেঞ্জের মশা ঔষধ বা কয়েল রয়েছে, যেগুলি সহজেই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। বাড়ির প্রত্যেক সদস্য যেন স্বাস্থ্যবিধিগুলি মেনে চলে কারণ ঘাম মশাদের আকৃষ্ট করে। বাচ্চাদের বাইরে যাওয়ার সময় লম্বা হাতার শার্ট, লম্বা প্যান্ট, জুতা এবং মোজা পরান। যেখানে মশার উপদ্রব বেশি সেখানে দিন এবং রাতে তাদের বিছানায় মশারি ব্যবহার করতে হবে। বাচ্চারা দিনের বেলা বাইরে যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে তা সীমিত করুন, বিশেষ করে ভোর ও সন্ধ্যার সময়, যখন মশা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের মহামারী রয়েছে এমন এলাকা থেকে দূরে থাকুন এবং পরিবার পরিজনদের দূরে রাখুন।