বড় কোনো বন্যায় ভাসিনি কখনো। শুধু একবারকার কথা মনে পড়ে, ১৯৮৮-এর বন্যা ছুঁয়ে গিয়েছিল আমার কিশোর মনন। তখনো আমি অনেক ছোট, স্কুলে পড়ি। বেশ মনে আছে, আমাদের এলাকায় কারো বাড়ি অ-প্লাবিত ছিল না। সারা বাড়িতে পানি উঠলেও শুধু আমাদের ঘরের মেঝে তখনো অধরা। পাশের বাড়ির একজনকে সাপে কাটল। খুব বিষধর নয় বুঝি! ওঝা এলো, মন্ত্র পড়ে সাপের বিষ নামানো হবে। কিন্তু ওঝা বলল, মাচানে বা নৌকায় রেখে এই রোগীর বিষ নামানো সম্ভব নয়, মাটি চাই মাটি। মানে যে বাড়ির মেঝে এখনো বন্যার পানিতে ডোবেনি এমন কোনো ঘরে নিয়ে সাপের বিষের মন্ত্র পড়তে হবে। তাকে আনা হলো আমাদের ঘরে। এক কিশোরী। দেখে মনে হয় মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। অথচ আমরা জানি সাপেকাটা রোগীকে কখনো ঘুমাতে দিতে নেই, তাকে জাগিয়ে রাখতে হয়! মেয়েটি সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিল। হয়তো মামুলি ঢোঁড়াসাপে কেটেছিল তাকে। কিন্তু তাতে বানভাসি মানুষের কষ্টের ফিরিস্তি কিছু কমেনি। বস্তুত, সেই প্রথম আমি বানভাসি মানুষের কষ্ট দেখি।
বন্যা মানেই বাস্তুচ্যুতি, বান এলেই মানুষ গৃহহীন শুধু নয়, ঘরে-বাইরে তার বিপদের অন্ত থাকে না। যাদের যাওয়ার কোথাও নেই তারা কলাগাছের ভেলায় ভাসে। বানভাসি শব্দটির প্রকৃত অর্থ তাদের জীবনে চরমভাবে সত্যি হয়! তারা ভেলায় চড়ে ভাসতে থাকে অনিশ্চিতের পথে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে এর ব্যাপকতা অনুভব করা সম্ভব হয় না। আট-দশজনের বিশাল পরিবার। ঘরে চাল বাড়ন্ত, খাবার নেই। এরা ধনিক শ্রেণির নয় যে, ঘরে জমানো কড়কড়ে টাকা থাকবে বা শুকনো খাবার। এরা দিন এনে দিন খায়। এদের দুচোখে রাজ্যের হতাশা, পেটে খিদে, আমার ওপর খোলা আকাশ। থাকার জায়গাটি অব্দি নেই। বানভাসিদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র আছে, কিন্তু কতখানি? কতজনের আশ্রয় জোটে সেখানে! আশ্রয় যদিও বা পেল, তাদের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল কোথায় থাকবে! এসব পরিবারে পোষা প্রাণীও নিজের প্রাণের মতোই আপন ও প্রয়োজনীয়। এদের ফেলে ওরা যায় কি করে! যায় কোথায়! সেই যে আটাশির বন্যার কথা মনে পড়েÑ একদল বুভুক্ষু মানুষ কোষা নৌকায় চড়ে খাদ্যের খোঁজে মাঠে নামে। মাঠ মানে জলে নিমজ্জিত সাগর যেন। যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। পেট তো কাব্য বোঝে না। তাই ওরা ছেলেপুলে নিয়ে সেই জলেভাসা মাঠে যায় যদি কিছু জোটে! কী আর জুটবে- কিছু পানিফল, কচুঘেঁচু এই তো! কিন্তু সেসব খাবে কি করে! রান্না করবে যে তার লাকড়ি কই! সবই তো ভেসে গেছে বানের জলে! যাদের বয়স অল্প, শুরুতে তারা হয়তো বানের সর্বনেশে ব্যাপকতা ঠিক বোঝে না। মনের আনন্দে ঝাঁপাঝাঁপি করে পানিতে। জাল নিয়ে যায় মাছ ধরবে বলে। কিন্তু এই বিপুল পানির সমারোহে মাছ কই, মাছের দেখা তো আর মেলে না।
মাছ পেলে তাও বেচেটেচে কিছু চাল-নুন হয়তো খরিদ করা যেতো। বানের পানিতে মাছ থাকে না, তাই ধীবরের জীবন আরও কষ্টকর করে তোলে এই মাছের দুষ্প্রাপ্যতা। নিজের পায়ের নিচে ঠাঁই নেই, তাই গবাদিপশুর খোঁজ আর নেবে কি করে! ওরা অনাহারে-অর্ধাহারে পড়ে থেকে একসময় ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আহা রে, বড় প্রিয় লাল গরুটা আজ রাতেই মরে গেল! বা মিশমিশে কালো ছাগলটার সহসাই আর দেখা মেলে না। হারিয়ে গেছে বা বানের পানিতে ভেসে গেছে নির্ঘাত। যারা বানভাসি তারা দুমুঠো খাবারের অন্বেষায় চেয়ে থাকে, সরকারি ত্রাণ আসবে বলে। তাদের অপেক্ষার প্রহর ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, কিন্তু ত্রাণের দেখা আর মেলে না বা গুমগুম শব্দ তুলে ত্রাণবাহী ইঞ্জিনবোট এলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা বড়ই অপ্রতুল। ত্রাণের আগমনে প্রাণে জোশ আসে না কারো। কাড়াকাড়ি, মারামারি করে কেউ হয়তো কিছু নেয়, আর কেউ চেয়ে থাকে ক্লান্ত চোখে। বুড়ো মানুষ, গায়ে তত তাগত নেই যে লড়াই করে কেড়ে নেবে! হায়রে মানুষ! কী স্বার্থপর! প্রতিবেশীর জন্য একটুও সহমর্মিতা থাকতে নেই! রাত বাড়ে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পানি। মমতাজির মনে একটু মায়া-দয়া নেই, ওপারে পানি বাড়ার খবরে দিদিমণি গেট খুলে দেন। ফলে পানি উপচে আসে এপার বাংলায়। মুখে যতই বলি আর ইলিশ পাঠাই, এভাবে কি সুসম্বন্ধ হয়, না টিকে থাকে! চাল আসছে, সরকারি তরফে জব্বর খবর। প্রেসনোট বলে, দেশে চালের কোনো অভাব নেই, শুধু খেতে পায় না ওইসব ভুখা-নাঙ্গা মানুষ! রাত বাড়লে বানভাসি মানুষের চিন্তা বাড়ে, কারণ পানির উচ্চতা তখন আর কারো নজরে পড়ে না। টঙের ওপর শুয়ে রাতটুকু জাগবে বলে যারা তৈরি, তাদেরও চিন্তার অবধি নেই। রাত না পোহাতেই টঙ জলে ছুঁইছুঁই হবে না তো! তদুপরি সাপখোপের ভয় তো আছেই! যারা খেতে পায় না, খিদে পেটে তাদের চোখে ঘুম নেই। আরেক শ্রেণির মানুষ এখন নির্ঘুম জাগে, যারা কিনা ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত। সহসাই শোরগোল ওঠে, সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে চাল পাচার হচ্ছে। গুদামের ম্যানেজারের নেতৃত্বে কাজকাম চলছে, এ চোর ধরবে কে! আহ রে মানুষ! কারো পেটে খাবার নেই, আবার কেউ রাতের আঁধারে পরের হক মেরে খায়। বানভাসি মানুষের দুঃসহ কষ্ট কি ওরা দেখতে পায় না! আমার সব বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়ায় যখন দেখি, বানের পানিতে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল পেতে বসেছে ওইসব মুনাফাখোর অমানুষ।
মানুষ বানের পানিতে ভাসছে ভাসুক, কিন্তু ঋণের কিস্তি মারা চলবে না। শোধ দিতেই হবে। কিস্তির টাকা নগদে চাই, নইলে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে অফিসে নিয়ে যাবে অসহায় বুভুক্ষুদের। ফেল কড়ি, তার পর নিজেকে ছাড়িয়ে আনো। আশ্চর্য! এই ক্ষুদ্র ঋণের পথ দেখিয়ে যদি জোটে নোবেল প্রাইজ, রবিঠাকুর কেন তবে মিছে কষ্ট করে কলম পেষতে গিয়েছিলেন! তার বদলে তাগড়া দেখে দু-চারটে ছাগল পুষলে পারতেন! মানবতার এই নির্মম পরিহাস সত্যি মানা যায় না! ত্রাণ দিলেই তো হবে না, সঙ্গে টিভি-ক্যামেরা চাই। জনসেবা করছি অথচ জনগণ জানল না! এ তা হলে কেমন সেবা হলো! বানভাসি মানুষের কপালে খাবারের চেয়ে খবর বেশি জোটে। তেলা মাথায় খুব তেল পড়ে। যারা পায়, শুধু তারাই পাবে। কষ্ট করে একটু বেশি বানভাসিদের জন্য কেউ ত্রাণ নিয়ে যাবে না। কারণ সেখানে ছবি উঠবে না যে! মিডিয়া কাভারেজ কোথায়! দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে ওরা বাঁচে কি করে! সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আসে অঝোরে বৃষ্টি। জামাকাপড় শুকাবে সেই উপায়ও নেই। নিচে পানি ওপরেও পানি, ফলে ওদের জান নিয়ে টানাটানি। অসুখ করেছে অথচ ওষুধ নেই, পথ্যও নেই। চারদিকে থৈ থৈ পানি, অথচ মুখে দেওয়ার উপায় নেই। এভাবেই ওরা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে নিতান্ত অনাদর-অবহেলায়। সত্যি, বানভাসি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটু পাশে গিয়ে দাঁড়াবার সময় কি আমাদের কারো আছে!
লেখক :: অরুণ কুমার বিশ্বাস : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক