চিকনগুনিয়া মশাবাহিত জ্বর। ডেঙ্গু জ্বরের মতো এটারও বাহক এডিস মশা। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর মত চিকনগুনিয়া প্রাণঘাতি নয়। তাই এ নিয়ে ভীতির চেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। আপনার চিকনগুনিয়া হয়েছে কি না তা আগে নিশ্চিত হতে হবে। তারপর এর জরুরি চিকিৎসা করা হতে।
তবে চিকনগুনিয়া রোগ হলে চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই যেন রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া না হয়, সেজন্য বিশেষ পরামর্শ চিকিৎসকদের। তবে তার আগে চলুন জেনে নিই রোগটি সম্পর্কে।
চিকনগুনিয়া কী?
চিকনগুনিয়া প্রথম দেখা যায় আফ্রিকান দেশ তানজানিয়াতে। তাই এই রোগের নাম ‘চিকনগুনিয়া’। শব্দটিও এসেছে তানজানিয়ার ভাষা থেকে। ‘চিকনগুনিয়া’ শব্দটির অর্থ বেঁকে যাওয়া। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁকে যাওয়ার কারণেই এ রকম নামকরণ। এর ভাইরাসটি মূলত আফ্রিকান হলেও বাংলাদেশে চিকনগুনিয়া আসে ভারতের কলকাতা থেকে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে ডেঙ্গু (এডিস মশা) আছে। এর বাহক Adese Aegypti (এডিস ইজিপট) মশাই চিকনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাসের বাহক। তাই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর নির্যাস রয়েই গেছে। বৃষ্টির পানি যেখানে জমা হয় সেখানে ডিম ফুটে বাচ্চা দিচ্ছে এই মশাগুলো। তবে চিকনগুনিয়া ভাইরাসটি ভারতের কলকাতা থেকে এদেশে এসেছে।
জানা গেছে, ১৮৬২ সালে সর্বপ্রথম তানজানিয়ায় চিকনগুনিয়া রোগ দেখা দেয়। ২০০৮ সালে প্রথম বাংলাদেশে এই রোগ দেখা দেয়। এরপর ২০০৯ সাল, ২০১১ সাল, ২০১২ সাল, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এই জ্বর ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে দোহার, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই রোগে বিভিন্ন বয়সের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
যেভাবে আক্রান্ত
চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি অন্য কোনো মশা কামড়ায়, তবে সেই মশার শরীরে চিকনগুনিয়ার ভাইরাস প্রবেশ করবে। এবার সেই মশা যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায় তবে সেই ব্যক্তিরও চিকনগুনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে শতভাগ। এভাবে আর দশটা মশা আক্রান্ত ব্যক্তিদের কামড়ালে সেই দশটা মশা থেকে চারদিকে মানুষ ও মশাগুলোর শরীরে চিকনগুনিয়া ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এটাই ভাইরাল।
চিকনগুনিয়ার লক্ষণ
১. ভীষণ জ্বর হয়, যেটা ১০৪ ডিগ্রি হবে।
২. শরীরের প্রত্যেক জোড়ায় জোড়ায় অসহনীয় ব্যথা। হাত ও পা বেঁকে যায়। ব্যথার কারণে হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল ও জোড়া ফুলে যায়।
৩. হাঁটু ও পায়ের পাতায় অসহ্য ব্যথার কারণে হাঁটা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।
৪. সারা গায়ে একেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত লাল লাল দাগ দেখা যায়। এগুলো প্রথম দিকে খুব চুলকায়।
৫. অনেকের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডে ব্যথা হতে পারে। ব্যথার কারণে বিছানা থেকে ওঠা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
চিকনগুনিয়ার চিকিৎসা
আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটা চলা একেবারেই নিষেধ। তবে বিশেষ প্রয়োজনে হাঁটতে হলেও সিঁড়ি বেয়ে উঠা-নামা সম্পূর্ণ নিষেধ। রিকশা বা গাড়িতে উঠতে হলে ফুটপাতের মতো উঁচু অংশ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকনগুনিয়ার লক্ষণগুলো আপনার মধ্যে দেখা গেলে বুঝে নিবেন যে আপনি আক্রান্ত হয়েছেন। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অস্থির হবেন না। চিকনগুনিয়া জ্বর সাত থেকে আট দিনের মধ্যে ভালো হতে পারে।
তবে এই কয়েক দিন শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে খুব ব্যথা থাকবে। এর প্রকোপ প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। অনেক চিকিৎসক প্যারাসিট্যামল ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু জ্বর কমানোর জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তবে ব্যথার কমানোর জন্য কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না।
চিকনগুনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি নেই
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে কমতে পারে চিকনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব। তাই ঘরের টবের পানিসহ বাড়ির আশেপাশে ছোট জলাধার প্রতিদিন পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, চিকনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হলে ভয়ের কিছু নেই। এই ভাইরাস জ্বরে কোনো মৃত্যু নেই, তবে দুর্ভোগটা খুব বেশি হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, নতুন করে এই জ্বর দেখা দিয়েছে। তবে ভয়ের কোন কারণ নেই। এই রোগ নির্ণয়ের নতুন কিট বের হয়েছে। বাংলাদেশে আগে ছিল না। এখন পাওয়া যায়। এই রোগের বাহক এডিস মশা। এটা এক ধরনের ভাইরাস জ্বর। কষ্ট হয়, শরীরের জয়েন্টে ব্যথা ও অস্বস্তি লাগে। ব্যাপক হারে শরীরে জ্বালা-যন্ত্রণা দেখা দেয়। মাঝে মধ্যে শরীরে চুলকানি ও গায়ে লাল রেশ হয়। এটা কয়েক সপ্তাহ থাকে। সম্প্রতি এই জ্বর ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে যে মশা কামড় দিবে ওই মশা আরেক জনকে কাড় দিলে তারও এই জ্বর হবে। এটা প্রতিরোধে মশা নিধন একমাত্র উপায় বলে তিনি মনে করেন।
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী মুঠোফোনে বলেন, চিকনগুনিয়া এক ধরনের মশাবাহিত ভাইরাস। এর উপসর্গ সিনড্রম ডেঙ্গুর মতো হলেও আতঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এতে মৃত্যু হয় না। রক্তের অনুচক্রিকা বা প্লেটলেট ১ লাখ থেকে দেড় লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
এই সম্পর্কে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিনিয়র কীটতত্ববিদ রেজাউল করিম খান মুঠোফোন সংবাদকে বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা তিন ধরনের ভাইরাস বহন করে। একই মশা থেকে চিকনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ও ডেঙ্গুজ্বর হয়। রাজধানীর কাঠালবাগান, হাতিরপুর এলাকায় এই ধরনের মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চিকনগুনিয়ার যে উপসর্গ। ডেঙ্গুর উপসর্গ প্রায় একই ধরনের। তবে ভাইরাস আলাদা। গত ৫ থেকে ৬ মাস আগে কাঠালবাগানে এই ভাইরাস জনিত মশা পাওয়া গেছে। বিসয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।