ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, আমেরিকা ::
প্রায় এক বছর হতে চলল, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় গবেষণা করছি। ল্যাবরেটরি থেকে সাধারণত যখন বের হই তখন প্রায় ১০টা বাজে। কখনো কখনো ১১টা কিংবা ১২টা। বহুবার লক্ষ করেছি, এই গভীর রাতেও অনেকে বসে বসে কাজ করছে। তাদের ঘড়িগুলো যেন বন্ধ হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা তাদের সামান্যতম তাড়া দিতে পারে না। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ, রাত দুইটা পর্যন্ত কিছু বাস (সাটল) সার্ভিস দিয়ে রেখেছে। কেউ যদি গভীর রাতে বাসায় ফিরতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাহলে সে গাড়ি তাকে বাসার দরজায় পৌঁছে দেয়। সার্ভিসটা যেহেতু রাত দুইটা পর্যন্ত, তার মানে কেউ না কেউ সে সময় পর্যন্তই কাজ করছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
ভাবলাম, এই যে গভীর রাত পর্যন্ত রুমে রুমে আলো জ্বলছে, সেটার কারণেই এই দেশটা পৃথিবীর পরাশক্তি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খেটে যাচ্ছে প্রতিযোগিতা করে। একটা প্রতিযোগিতা যখন সঠিকভাবে দাঁড় করানো যায়, তখন সেখান থেকে সেরাদের সেরা বেরিয়ে আসে। আর এই প্রতিযোগিতায় লেগে থাকার জন্য, সমাজ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র দিচ্ছে তরুণদের জন্য এক প্রাণবন্ত পরিবেশ। আর তরুণেরা দেশের জন্য দিচ্ছে মেধা ও শ্রম! কী ঐকতান!
আমরা প্রায়ই আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের অলস বলেই দায়মুক্তি পেয়ে যাই। আসলে কি ওরা অলস? একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছারপোকার কামড় খেয়ে হলে রাত কাটায়। পাঁচ-ছয়জন স্টুডেন্ট গাদাগাদি করে একটি রুমে থাকে। ১০-১২ টাকায় পাঁচ-সাত বছর কুখাদ্য খেয়ে পাকস্থলী শেষ করে। বাসের ডান্ডা ধরে ঝুলে ঝুলে ক্যাম্পাসে যায়। ভিড়ের মধ্যে অন্যের ঘামের গন্ধ শোঁকে, ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করতে হয়। পরীক্ষার আগের রাতেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পায় না। টিউশনি করে মাস চালাতে হয়। কেউ কেউ সে টাকা থেকে বাড়ি টাকা পাঠায়।
একটা কম্পিউটার কেনার জন্য টাকা পায় না। এত সংগ্রামের পরও, ওরা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে। পড়ে যাচ্ছে। বড় বড় স্বপ্ন দেখে। আর যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়, তখন ওদের হাতে শুধু একটি সনদ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। না কোনো গবেষণার অভিজ্ঞতা, না কোনো প্রফেশনাল জীবনের সঠিক প্রস্তুতি! উপরন্তু জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয় কয়েকটি অতিরিক্ত বছর। আমরা এর নাম দিয়েছি সেশনজট। সেটার হিসাব কোথাও লেখা থাকে না। সেশনজটের মতো এমন ঘৃণ্য একটি বিষয় পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে নেই। সহস্র ছেলে-মেয়ের জীবন থেকে সময় কেড়ে নেওয়া, রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর অভিশাপ। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য কখনো বলেন না, ডিয়ার স্টুডেন্ট, ইউ আর সরি ফর দ্যাট। ইউ উইল ট্রাই টু মেক থিংকস বেটার!
অথচ এই ছেলে-মেয়েগুলোর বাবা-মায়ের ট্যাক্সের টাকা, রাষ্ট্র লুট করে নিচ্ছে। নেতারা পকেটে ভরছে। কী নির্মম! পৃথিবীর আর কয়টা দেশে, এত যুদ্ধ করে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে? একবার আন্তর্জাতিক স্টুডেন্টদের এক আড্ডায় আমাদের শিক্ষাজীবনের সংগ্রামের কথা বলেছিলাম। তাই শুনে, দেখলাম ওদের কেউ কেউ চোখ মুছছে। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা কত সংগ্রাম করে, কত কষ্ট করে—সেটা আমি গভীরভাবে জানি।
এরপরও কি বলবেন, এ দেশের ছেলে-মেয়েরা অলস! তারা পড়তে চায় না। তারা গবেষণা করতে চায় না! তাদের কতটুকু দিই—সেটা কি কখনো আমরা ভাবি? তাদের সামান্য চাকরির লোভে, এক কাপ চায়ের লোভে, একটি সিটের লোভে—নেতার গায়ের গামছা বানিয়ে রাখি। বড় ভাইদের দাস বানিয়ে রাখি! এমন ঘৃণ্য সিস্টেম কি কোথাও আছে? দুনিয়ার আর কোনো সমাজে কি মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে রাষ্ট্র এমন প্রতারণা করে?
তারপরও এই ছেলে-মেয়েগুলোর অটুট লক্ষ্য খুব বিস্মিত করে। রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ওরা স্বপ্নের সঙ্গে আপস করতে চায় না। ওদের মধ্যে, নিজেকে আলোকিত করার যে দৃঢ় প্রত্যয়, সেটাকে আমাদের সম্মান করা উচিত। আরও বহুগুণে জাগিয়ে তোলা উচিত। অথচ আমরা সেটা করছি না। আমরা বুঝতে চাই না, এই তরুণ প্রাণদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে একটি দেশ রাতারাতি এগিয়ে যায়। সারা দুনিয়ার উন্নত সমাজগুলো তাই।
যখন দেখি, ইউজিসির একজন চেয়ারম্যান রাজনৈতিক দলের গুণগান গেয়ে লেখার সময় পান অথচ দেশের সহস্র তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেন না, তখন খুব কষ্ট হয়। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে যে এত মূল্যবান সময় কেড়ে নেওয়া হয়, সেটার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে কি দু-বাক্য লিখেছেন? শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে সেশনজট নামক অভিশপ্ত বিষয়টি দূর করার জন্য কঠোর ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কি নিয়েছেন?
যে দেশ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের ভালো রাখার চেষ্টা করে, তাদের দুঃখ কান পেতে শোনে, সে দেশটা নীরোগ থাকে। সে দেশ রক্ষার জন্য বিদেশ থেকে সহস্র কোটি টাকার অস্ত্র কিনতে হয় না। প্রত্যেক তরুণ, প্রতিরক্ষার একেকটি বারুদ হয়ে যায়!
ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, আমেরিকা