বরাবর
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
আসসালামু আলাইকুম। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আমার এই কামনাটুক নিঃস্বার্থ নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বরং এক ধরণের স্বার্থপরতার আঁচল থেকে খসে পড়া শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। একজন মানুষ যদি একটি দেব শিশুর পিতা হয়ে থাকে তবে সে আপনার জন্য এমন কামনা করতে বাধ্য! অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সনাক্তকরণ ও পূণর্বাসনে আপনার ও আপনার পরিবারের অবদানের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!
জ্বী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই আজকের এ খোলা চিঠির আশ্রয় নিয়েছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
আপনাকে ধন্যবাদ। কারণ, আপনার একান্ত আগ্রহের কারণেই অটিজম আজ অনেক বেশি পরিচিত একটি শব্দ। মানুষ জানছে অটিজমের কথা, জানছে তাদের সুস্থতার কথা। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে অনেক শিশু। সুস্থ হওয়ার প্রত্যাশায় স্বপ্নগুলোকে নতুন করে সাজাচ্ছে অনেক পরিবার! এজন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
এতো কিছুর পরেও দু:খের বিষয় হল অটিজম বিষয়টাকে পুঁজি করে অনেকেই ব্যবসায় নেমেছে! ব্যবসার এ ধরণ আপনার কাছে একে একে তুলে ধরতে চাইঃ
০১. অটিজম একটি শিশুর বিকাশজনিত প্রতিবন্ধকতার নাম। আর দশজন প্রতিবন্ধি শিশুর সাথে তাদের স্পস্ট পার্থক্য আছে। প্রতিবন্ধী আর অটিজমকে তাই এক করে দেখার সুযোগ নেই। অথচ শুধুমাত্র ব্যবসায়ীক স্বার্থে অনেক প্রতিবন্ধী স্কুল তাদের নামের সাথে অটিজম শব্দটি জুড়ে দিচ্ছে। যেখানে সাধারণ প্রতিবন্ধীদের সাথে অটিজম শিশুদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। যা উভয় গ্রুপের শিশুর জন্য সমভাবে ক্ষতিকর।এমনকি অটিজম দিবসেও যেসব শিশুকে আপনার সামনে তুলে ধরা হয় তাদের সত্তরভাগ শিশুই সাধারণ প্রতিবন্ধী, অটিজমে আক্রান্ত নয়।
০২। অনেকে স্মার্ট সাজতে ডায়রিয়া না বলে ডিসেন্টেরি শব্দটি ব্যবহার করে। ঠিক তেমনি অনেকে ইদানিং প্রতিবন্ধী শব্দের পরিবর্তে অটিস্টিক শব্দটি ব্যবহার করে।ফলে এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এর সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সঠিকভাবে অটিজম নির্নয় করার আগেই তাই মা বাবাকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে এসব শিশুকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করার। সাধারণ প্রতিবন্ধীদের থেকে এদের টেক কেয়ারে অনেক পার্থক্য আছে।
৩। সাধারণ স্কুলে শিশুদের কোনরকম কোচিং এর প্রলোভন দেখানোটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ অটিজম শিশুদের স্কুলে নিদির্স্ট বেতন দেয়ার পরও আলাদা করে কোচিং ফি দিতে হয়। যা তারা থেরাপি দেয়ার নামে নেয়। ব্যয়বহুল এসব স্কুলের বেতন পরিশোধের পাশাপাশি বাড়তি ফি প্রদান করা অনেকের জন্য বেশ কষ্টকর। সব স্পেশাল স্কুলে না হলেও বেশিরভাগ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এ অনৈতিক ব্যবসার সাথে জড়িত।
৪। সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকও সরাসরি এসব কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িত। অনেকে আবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে বাড়তি টাকার বিনিময়ে থেরাপি দিচ্ছেন।
৫। স্পেশাল স্কুলে এসব শিশুদের আলাদা করে চিকিৎসার সুযোগ নেই। ফলে চিকিৎসা দিতে গিয়ে এসব শিশুকে নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
এদের জন্য সমাজকর্মীদের লোক দেখানো হাহাকার থাকলেও বাস্তবিক উদ্যোগ খুব কম চোখে পড়ে।
৬। সরকারীভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তির ক্ষেত্রে একমাত্র তদ্বিরকে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
৭। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রতিজনের বিপরীতে একজন করে শিক্ষক লাগে। ফলে বেসরকারী স্পেশাল স্কুলগুলোও এতো শিক্ষকের বেতনভার বহন করতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে তারাও অনেকটা বাধ্য থাকেন বেতন বাড়াতে।
৮। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের পূণর্বাসনের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই। নেই কোন সাধারণ স্কুলে পড়ার সুযোগ। কেউ একটু সুস্থতার দিকে ফিরলেও ইনক্লুশন স্কুলে পড়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। পিতামাতার অবর্তমানে তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে কিভাবে এসব শিশুর দেখভাল হবে তারও নেই সুনিদির্স্ট নীতিমালা। বরং প্রতিবন্ধী আইনে ট্রাস্টির মাধ্যমে এদের জন্য কিছু করে না গেলে পিতামাতার সম্পদ থেকেও বঞ্চিত হবে এরা। সে সম্পদের মালিক হবে কেবল রাষ্ট্র। আমার জানায় ভুল থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে অল্প কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হল। এগুলো কষ্টের কথা, হতাশার কথা হলেও সরকারী-বেসরকারী এসব স্কুলের কল্যাণে অনেক শিশু প্রতিনিয়ত আলোর মুখ দেখছে। দরকার তাই আরেকটি সহানুভূতির, আরেকটু উদ্যোগের, আরেকটু পৃষ্ঠপোষকতার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
উপরে বর্ণিত সমস্যা সমাধানে আমি নিম্নলিখিত প্রস্তাবনাগুলো আপনার সদয় বিবেচনার জন্য পেশ করতে চাইঃ
১। দেশের সব সরকারী বেসরকারী সাধারণ স্কুলে অটিজম শিশুদের জন্য আলাদা শাখা খোলা হোক। এতে করে তাদের জন্য আর নতুন কোন স্কুল খুলতে হবে না। পাশাপাশি সাধারণ শিশুদের সাথে মিশতে পারবে এসব শিশু যা তাদের চিকিৎসারও অংশ।
২। স্পেশাল বেবিদের শিক্ষাদানের সাথে জড়িত স্পিচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্টসহ সব পেশাজীবিদের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হোক। একই সঙ্গে তাঁদের সরকারী চাকরীর নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হোক।
৩। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের পরিবারকে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেয়া হোক কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁদের আর্থিক ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হোক।
৪। অটিজম শিশুদের চলাফেরা নিশ্চিত করতে তাঁদের নিদির্স্ট কালারের আইডেন্টি কার্ড সরবরাহ করা হোক।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
অটিজম শিশুরা নয়, Disable নয়। তারা Differently able. তাই তাদের সে Ability কে ফুটিয়ে তোলার জন্য আজকের এ চিঠির আশ্রয় নেয়া।
অটিজম একটি আবৃত কলির নাম। এ আবরণের পুরুত্ব একেকজনের একেক রকম। সময় মত এ আবরণ খুলে দিলে ফুটবে সে কলি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে এসে তাঁদের মত করে নিজেকে তুলে ধরা আপনার সুন্দরতম স্বভাবের একটি। আপনি তাই জানেন ভালবাসার রঙ নীল। বেদনার রঙও নীল। অটিজমের রঙও নীল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ২ এপ্রিলের সবটুকু নীল তাই আপনার জন্য।
আপনার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনায়
——————————————–
সাকলায়েন রাসেল
আরিজের পিতা।
লেখক: চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়