(আবুল আলম)
সপ্তম শ্রেণীতে (১৯৪১) ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন ‘রহিম স্যার’; আসল বইটির নাম ছিল ‘Choice Readings’! না, এখানে বই নিয়ে কোন কথা নয় – সব কথা শুধু আমার অতি প্রিয় ‘রহিম স্যার’ কে নিয়ে।
স্যার সাধারণ বি এ পাশ হলেও, ওনার ইংরেজি ভাষার উপর দখল ইংরেজিতে ‘সম্মান’ ডিগ্রী ধারী অন্য শিক্ষকের চেয়ে বেশী ছাড়া কম ছিলনা।চমৎকার পড়াতেন; আর উচ্চারণ? কলেজ-ইউনিভার্সিটি, বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করে, ৭০ বছর পরে আজও বলব, ওনার কাছে যে ভাবে ইংলিশ উচ্চারণ শিখেছিলাম, তা ছিল নির্ভুল।
ইংরজি ভাষার একটা অসাধারণ দিক সম্পর্কে উনি সেই কচি বয়সেই আামাদের অবহিত করেছিলেনঃ একটি শব্দ থেকে কী ভাবে একটু একটু বদল করে – শব্দটির ডাল-পালা ধরে – অনেক গুলো শব্দ হয়ঃ যেমন, ‘steal, stealth, stealthy, stealthily’ বা ‘beauty, beautify, beautifier, beauteous, beautiful, beautifully, beautician’ ইত্যাদি, যাতে করে, একটি শব্দ শেখার সাথে সাথে বেশ ক’য়েকটা শব্দ রপ্ত হয়ে যেত ।ইংরেজি ব্যাকরণ ওনার শেখানোর বিষয় না হলেও, সাহিত্য পড়াবার ফাকে ফাকে সুকৌশলে ব্যাকরণও শিখাতেন। অন্য সকল শিক্ষক থেকে ওনার শেখাবার ধরণটাই ছিল আলাদা, যা এতদিনেও ভুলিনি, ভুলব না।
এহেন শ্রদ্ধেয় স্যরের একটা অদ্ভূত, বিরল, দূরারোগ্য অসুখ ছিল যা থেকে উনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রেহাই পাননি!অসুখটার একটা গালভারী নাম আছেঃ নার্কোলেপসী (Narcolepsy)! উনি যখন-তখন, স্থান-কাল নির্বিশেষে হঠাৎই নিজেরও অজান্তে ঘুমিয়ে পড়তেন। এমনটা মাঝে মাঝে হত শ্রেণী কক্ষেও – এই পড়াচ্ছেন, এই ঘুম!সাইকেলেই বেশী যাতায়াত করতেন – তো, দু’এক বার ঘুমিয়ে সাইকেল সহ রাস্তার পাশে পরে গিয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে!
এ ঘুম ঠেকানোর এক মাত্র উপায় ছিল ধূম পান; যে কারণে স্যার ক্লাসে পড়াবার সময়ও মাঝে মাঝে বিড়ি (সেকালে সিগারেটের প্রচলন ততটা ছিল না, ছিল ব্যয়বহুলও) টানতেন – কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারেই!
চশমা (উত্তল লেন্সযুক্ত) দিয়ে যে সূর্যালোক থেকে আগুন পাওয়া যেতে পারে তা’ও রহিম স্যারের কাছেই প্রথম শেখা!মাঝে মাঝে যখন ম্যাচ থাকত না, স্যার তাঁর চশমা জোড়া খুলে আমাদের কোন একজনকে বিড়ি ধরাবার জন্য বাইরে, মাঠে পাঠিয়ে দিতেন।অনেক সময় এমনও হত যে, বিড়ি ধরিয়ে ক্লাস রুমে আসার মধ্যে স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন!তো, ওই সব ফক্কর ছাত্ররা নিজেরাই বিড়িটার সদব্যবহার করতো।তো, পরবর্তীতে এ কাজটার ভার আমার উপর বর্তায়, কারণ স্যার জানতেন আমি ধূমপান করিনা। আমি বিড়ি ধরিয়ে এনে সাথে সাথে স্যারকে দিতাম – ঘুমিয়ে পরলে, ঘুম ভাঙ্গিয়ে!
আমি ঐ স্কুলেরই একজন শিক্ষকের ছেলে বলে, আমার প্রতি স্যারের একটু বিশেষ খেয়াল/স্নেহ-বিবেচনা ছিল।স্যারেরও এক ছেলে আমাদের স্কুলে পড়ত; আমার এক ক্লাস নীচে – আব্দুল মোনায়েম; কোথায় কী ভাবে আছে কোন হদিস রাখতে পারিনি।
রহিম স্যারের কথা ভুলি নাই, ভুলব না! না ফেরার দেশে কুসুমাস্তীর্ণ হোক তার চির শান্তির পথ!
এখনও হঠাৎ করেই স্যারের কথা মনে পড়ে, স্মৃতিতে ভেসে আসে শ্রেণীকক্ষে চেয়ারে বসে আছেন আমার অতি প্রিয় স্যার, চোখে পুরু গ্লাসের চশমা আর মুখে একটি সাধারণ বিড়ি!
লেখক:
আবুল মকসুদ নুরুল আলম
ভাষা সৈনিক
www.facebook.com/abul.alam