বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্ম আব্দুুর রউফ । এই মনিষির জন্মদিন ১ লা ফেব্রুয়ারী । ২০১২ সালে সিসিএন এর পক্ষ থেকে তার স্বাক্ষাতকার নেয়া হয়, বন্ধুরা সফল এই মানুষটির কথা তোমাদের জন্য তুলে ধরা হলো। আব্দুুল্লাহ, রাফিউন এবং ফাহিমকে সঙ্গে নিয়ে স্বাক্ষাতকার গ্রহন, রিপোর্ট এবং সম্পাদনা করেছেন সিসিএন এর বিভাগীয় সম্পাদক(সাব এডিটর) সামিউন বিনতে সফি।
রউফ ভাইয়ার সাথে কিছুক্ষন :
৩রা মার্চ, ২০১২। সময় সন্ধা ৭ টা। রউফ ভাইয়কে ফোন করলাম। ও তোমাদেরতো বলাই হয়নি, বরনীয় এই মানুষটাকে ভাইয়া বলে ডাকি
যে ভাবে শুরুঃ
– আস্সালামুআলাইকুম
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– ভাইয়া আমি সামিউন বিনতে সফি বলছি। কালকে আপনার সাক্ষাতকার নিতে চাচ্ছি।
– কি বিষয়ে ?
– ভাইয়া আপনার ছেলেবেলা সম্মন্ধে কিছু জানতে চাই।
– হা হা হা… আমার ছেলেবেলা ! মনে আছে নাকি ?
– আমাদেরকে (শিশুদেরকে) দেখলে ঠিক মনে পড়ে যাবে।
– ঠিক আছে, কালকে এসো।
– জ্বি, আস্সালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম…।
সেদিন রাতেই ঠিক করে নিলাম কি কী প্রশ্ন করব। হুম… ২৭ টা প্রশ্ন হয়েছে। তবে উত্তরগুলো বড় হবে।
৪ ঠা মার্চ, সকাল ১০ টা। আমি, ভাইয়া আর রাফিউন রওনা দিলাম। আব্বু আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। গুলশান-১, রোড-১৬, বাড়ি-৯। রউফ ভাইয়ার বাসায় পৌছে আমরা কিছুক্ষন বসলাম। ভাইয়া তাঁর কাজকর্ম শেষ করে আমাদেরকে ডাক দিলেন। কুশল বিনিময়ের পর আমরা ভাইয়াকে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। তিনি শুধু তাঁর চোখ বুলাচ্ছিলেন আর সব প্রশ্ন একসাথে শুনলেন। – হে এতগুলো প্রশ্ন !! একটা বই-ই তো হয়ে যাবে। – ভাইয়া, আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে চাচ্ছি। (আমাদের সি.সি.এন- এর উদ্যোগে নতুন পত্রিকায়)।
এরপর তিনি তাঁর পুরো জীবনের গল্প শুনালেন। ভালোই লাগছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা পর আব্দুল্লাহ ভাইয়া আসল। এতক্ষন আমরা ডায়েরীতে রউফ ভাইয়ার কথা টুকে নিচ্ছিলাম। আমাদেরকে নাসতা দেওয়া হল। খাচ্ছিলাম আর শুনছিলাম–
পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য, আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে, বর্তমান শিশুদের কি করা উচিত ইত্যাদি।
প্রশ্নোত্তর :
ভাইয়া, আপনার জন্ম কত সালে এবং কোথায় ?
আব্দুুর রউফ ঃ আমার জন্ম ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৪ সালে। ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জে।
আপনার মা বাবার কথা কিছু বলেন।
আব্দুর রউফ ঃ আমর বাবা ১৯০৬ সালে ময়মনংিহের প্রথম মুসলমান ডাক্তার ছিলেন। নাম- আলহাজ্ব ডাক্তার জোনাব আলী। মায়ের নাম মরিয়ম নেসা।
আপনারা ভাইবোন কতজন ছিলেন ? আপনি কততম ?
আব্দুুর রউফ ঃ চার ভাই, ছয় বোন। আমি অষ্টম। বোনেরা সবাই আমার বড়।
তাহলে নিশ্চই অনেক আদর পেয়েছেন ?
আব্দুর রউফ ঃ আসলে আমি জন্মের পর থেকেই অসুস্থ ছিলাম। মা বলতেন শীতের সময় আমাকে কুলার ভিতরে রেখে লালন পালন করতেন।
আপনার গ্রামের বাড়ি সম্মন্ধে কিছু বলুন।
আব্দুুর রউফ ঃ আমার বাড়ি ময়মনসিংহের কোতয়ালী থানায়। শহর থেকে ৫ মাইল দক্ষিন পশ্চিম দিকে।
বাড়িতে এখন কে থাকেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ আমার সব ভাইবোনই ঢাকায় থাকেন। ইমেডিয়েট ছোট ভাই পরিবার নিয়ে বাড়িতে থাকেন। আমার সবচেয়ে ছোট ভাই মারা গিয়েছেন। তাঁর স্ত্রীও ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেখানেই থাকেন।
প্রথম কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ আমার বাবা যখন কেন্দুয়া হসপিটাল এর ডাক্তার ছিলেন তখন আমাকে ৬ বছর বয়সে কেন্দুয়া হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সে সময় ৬ বছরের আগে স্কুলে ভর্তি করানো যেত না। আমি ক্লাস ওয়ান এ ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাস টু পর্যন্ত সেখানে পড়েছিলাম।
কøাসে কেমন ছিলেন ? শিক্ষকেরা আপনার সম্মন্ধে কি বলতেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ ভালোই ছিলাম। শিক্ষকরা ভালোই বলতেন। আমাদের সময় তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এজন্য নানারকম প্রশিক্ষন দেওয়া হত। বোমা থেকে কীভাবে বাঁচতে হবে তা শিক্ষা দেওয়া হত। বাড়িতে থাকলে খাটের নিচে থাকতে বলে দিত। বলত বালতি ভরে পানি রাখতে। হে হে হে…
বোমার শব্দ শুনলে কান ধরে রাখতাম।
এরপর ?
আব্দুুর রউফ ঃ এরপর বাড়িতে আসলাম। গোষ্ঠাকান্দাপাড়া প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস থ্রী আর ফোর পড়লাম। ফোর এ পাবলিক পরীক্ষা ছিল। আমি আর ইমেডিয়েট বড় বোন পালকিতে চড়ে পরীক্ষা দিতে যেতাম। বৃত্তিও পেয়েছিলাম। এরপর খেরোয়াজানী মাইনর স্কুলে ক্লাস ফাইভ ও সিক্স পড়লাম। সিক্স এ বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমাদের সময় সকাল-বিকাল পরীক্ষা দিতাম। মাঝখানের টিফিন টাইমে আমাদেরকে ডাব খাওয়ানো হত।
সেভেন-এইট এ কোথায় পড়েছেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ ইশ্বরগঞ্জ হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। ৩য় বোন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে সেখানে ভর্তি করান। কিন্তু আমার মার জন্য মন কেমন করত। তাই চলে আসি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হই। বাসা থেকে পাঁচ মাইল দূরে স্কুল ছিল। এখনকার মত গাড়ি, রিক্সা ছিল না তো তাই ঘোড়ার গাড়িতে করে যেতাম। ক্লাস এইট এ আমাকে একটা চযরষরঢ় সাইকেল কিনে দেওয়া হয় তাতে চড়ে স্কুলে যেতাম।
এস.এস.সি পাস করেন কত সালে ?
আব্দুুর রউফ ঃ ১৯৫০ সালে।
রেজাল্ট কেমন হয়েছিল ?
আব্দুর রউফ ঃ ভালোই করেছিলাম। তবে আরও ভালো করতাম। আমাদের সময় ঢাকায় ইন্ডিয়া থেকে কমলা সার্কাস এসেছিল। আমরা কয়েকজন বন্ধু অফফরঃরড়হধষ গধঃয বীধস না দিয়ে ঢাকায় সার্কাস দেখতে আসছিলাম। ১ংঃ উরারংরড়হ পেয়েছিলাম।
আপনার জীবনের লক্ষ্য কি ছিল ?
আব্দুুর রউফ ঃ আমার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার। ১৯৪২ এ আমার বড় ভাই এম.বি.এস পাস করেন। তিনি চাইতেন না যে আমি ডাক্তারী পড়ি।
কোনো শিশু সংগঠনের সাথে কি যুক্ত ছিলেন ?
আব্দুর রউফ ঃ হ্যা, আমাদের সময় ব্রতচারী আন্দোলন ছিল। ১৯৪৭ এর আগে আমরা শিশুরা ব্রিটিশ খেদাও প্রভৃতি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে গান গাইতাম, নাচতামও।
কি খেলা খেলতেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ সব ধরনের খেলা খেলতাম। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কাবাডি এরকম সে সময় যত খেলা ছিল সবই খেলেছি।
আপনার প্রিয় খাবার কি ছিল ?
আব্দুুর রউফ ঃ আমরা তোমাদের মত এত সেয়ানা ছিলাম না। সেভেনে উঠার আগ পর্যন্ত আমাদের ধারনাই ছিল না যে- বাজারে মিষ্টি খাওয়া যায়। মা বাড়িতেই দুধ দিয়ে মিষ্টি বানাতেন। আমরা বাজারের কোনো কাপড়ও পরতাম না। মা বাড়িতেই কাপড় বানিয়ে দিতেন। তাই পরতাম। মায়ের একটা সিঙ্গার সেলাই মেশিন ছিল। সেটা আমার মেয়েকে দিয়েছেন। ১০০ বছরের পুরোনো।
ধর্মীয় শিক্ষা কার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ আমাদের ক্লাস ওয়ান থেকে দ্বীনিয়াত নামে একটা ক্লাস হত। মা আরবি শিখাতেন। আমাদের নিয়ম ছিল ফজরের পর কুরআন পড়তে হত। বাবা-মা কুরআন তেলওয়াত করলে তাদের পাশে বসে কুরআন পড়তে হত। তারপর বাবার সাথে হাটতে বেরোতাম। তারপর বাসায় এসে নাস্তা খেতাম। নাশতা খেয়ে পড়তে বসতাম। তারপর স্কুলে যেতাম।
ছোটবেলার কোন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে কি ?
আব্দুর রউফ ঃ আমাদের একজন উৎরষষ ঞবধপযবৎ ছিলেন। আমরা সিদ্দিক স্যার বলে ডাকতাম। তিনি আমাদেরকে বেত মারতেন। আদরও করতেন।
কখনও মার খেয়েছেন ?
আব্দুুর রউফ ঃ হ্যা … মার খেয়েছি। বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থেকেছি। কান ধরে উঠবস করেছি। তবে মনে মনে বলতাম,“আল্লাহ যা শাস্তি দেওয়ার এখানে দাও। ঘরে যাতে খবর না যায়।” বাবাকে খুব ভয় পেতাম।
বর্তমান শিশুদের নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি ?
আব্দুুর রউফ ঃ নতুন প্রজন্মের একটা সমস্যা হল তারা এতটাই ডিজিটাল এ বিশ্বাস করে যে নিজেদের উপর বিশ্বাসের চেয়ে তার প্রাধান্য দেয়। তাদেরকে নিজেদের মন মস্তিস্কের চর্চা করতে হবে। জীবন ভিত্তিক চিন্তা করতে হবে। সমগ্র সৃষ্টির পরিচর্যা করতে শিখতে হবে।
অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
আব্দুুর রউফ ঃ অভিভাবকদের বলব তাদেরকে সন্তানের খুব কাছাকাছি থাকতে হবে। তাহলে সন্তান বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।