(আহমেদ রিয়াজ )

probinঠক, ঠক, ঠক।

ঘরের দরজায় আলতো টোকা।
সারাদিন বনে-জঙ্গলে ঘুরে সন্ধের ঠিক আগে আগে ঘরে ঢুকেছেন কাঠুরে। ঘর বটে একখানা। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। বরফও পড়ছে। বরফের স্তূপ জমেছে ঘরের উপর। ওই বরফের চাপে কখন যে ঘরখানা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে কে জানে! দরজায় টোকা পড়লেও মনে হয় ঘরটা বুঝি দুলছে। কিন্তু ঘরটা যেন ওই টোকা টেরও পেলো না। অথচ শব্দ হলো বেশ। কে এলো তাহলে এই রাতে?

রাতের খাবার নিয়ে কেবল বসে ছিলেন তারা। ঘরটায় দুজন মাত্র মানুষ। কাঠুরে আর তার বউ। দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে দুজনই উঠে দাঁড়ালেন। একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। ফিস ফিস শব্দে কাঠুরে বললেন, কে এলো এই ঠাণ্ডার রাতে?
কাঠুরে বউ বললেন, কোনো অতিথি নয় তো?
অতিথির কথা শুনে বেশ খুশি হলেন কাঠুরে। অনেক দিন কোনো অতিথি আসেন না তাদের ঘরে।
কাঠুরে খুশি খুশি কণ্ঠে বললেন, অতিথি! রাতের খাবারটা তাহলে আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া যাবে। কী বলো?
কাঠুরে বউ বললেন, হু। আজ একটু বেশি করেই স্যুপ করেছি। দুজন অতিথি এলেও সমস্যা হবে না।
কাঠুরে বললেন, যাই, দরজাটা খুলে দিয়ে আসি। দেখি কেমন অতিথি এলো।
দরজা খুলেই অবাক হলেন কাঠুরে। চেঁচিয়ে বললেন, ও মা! কোথায় অতিথি? আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।
বলেই আবার আলতো করে দরজাটা আটকে দিলেন। বসলেন রাতের খাবার খেতে।
তখনই আবার ঠক, ঠক, ঠক।

old man

আবার উঠে দাঁড়ালেন কাঠুরে। দরজার দিকে এগুতে যাবেন, ঠিক তক্ষুণি কাঠুরে বউ বললেন, যেও না। ওটা নিশ্চয়ই তুষার ঝড়ের শব্দ।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে খাবার সামনে নিয়ে আবার বসলেন কাঠুরে। আবার তখন, ঠক-ঠক-ঠক।
বউয়ের দিকে তাকিয়ে কাঠুরে বললেন, ওটা নিশ্চয়ই তুষার ঝড়ের শব্দ। কী বলো।
কাঠুরে বউ বললেন, এবার কিন্তু শব্দটা তুষার ঝড়ের বলে মনে হচ্ছে না। সত্যি সত্যি কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। তুমি ঠিক মতো দেখেছ তো?
কাঠুরে বললেন, সন্দেহ থাকলে নিজেই গিয়ে দেখে এসো।
এবার কাঠুরে বউ দরজা খুললেন। ইতি উতি তাকালেন। কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। দরজাটা বন্ধ করতে যাবেন, তখনই কে যেন বলে ওঠল, আজ রাতটা থাকতে দেবেন মা?

মাথা নিচু করে তাকালেন কাঠুরে বউ। ছোট্ট একটা মানুষ। অন্ধকারে চেহারাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। তবে কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে মানুষটা ছোট-শিশু।
কাঠুরে বউ বললেন, কেন দিবনা? প্রভু যিশু নিশ্চয়ই কোনো অতিথিকে ঘরের দরজা থেকে বিদায় দিতেননা? এসো এসো।বলেই হাত ধরে শিশুটিকে টেনে নিলেন ঘরে। তারপর দরজা আটকে দিয়ে বললেন, কী ঠাণ্ডা বাইরে! এসো বাছা। আমাদের ঘরে তো আগুন নেই। ওই বাতিটার কাছে গিয়ে বসো। একটু হলেও আরাম পাবে। ইশ, ঠাণ্ডায় একেবারে জমে গেছো দেখছি।
এবার অতিথিকে দেখে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কাঠুরে। বললেন, ঘরে আগুন নেই তো কী হয়েছে। আগুনের ব্যবস্থা করবো। অতিথির আরাম নিয়ে কথা।
ঘর গরম করার চুল্লিতে কাঠ দিলেন কাঠুরে। আগুন জ্বালালেন। আগুনটা জ্বলতে চায় নি। বেশ ঝামেলা করে তবে জ্বলেছে।

কাঠগুলো এখনও স্যাঁতস্যাঁতে। ততক্ষণে অতিথির খাবারের আয়োজন সেরে ফেলেছেন কাঠুরে বউ। বিশেষ দিনের জন্য একটা খাবার সরিয়ে রেখেছিলেন। সেটাই বের করলেন এখন। তারপর সুন্দর করে সাজিয়ে অতিথির সামনে দিলেন।

কিন্তু খাবারে হাত দিচ্ছে না অতিথি।
কাঠুরে বললেন, আমাদের খাবার তোমার পছন্দ হবে তো বাছা?
কাঠুরে বউ বললেন, এরচেয়ে বেশি কিছু আর নেই আমাদের।
অতিথি শিশু বলল, না না। ওতেই হবে।
কাঠুরে বউ এবার তার অতিথির দিকে ভালো মতো তাকালেন। কী সুন্দর মুখখানা। গোল গোল চোখ। কিন্তু অতিথির দুচোখের কোনায় পানি কেন?
আদুরে গলায় জানতে চাইলেন কাঠুরে বউ, তুমি কার ছেলে গো? বাড়ির কথা মনে পড়ছে? মায়ের কথা?
কাঠুরে বললেন, আমাদের কোনো কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো? কিংবা আমাদের কোনো আচরণ…
অতিথি শিশু বললো, না। কিন্তু আপনারা এতো ভালো কেন? আরো কয়েকটা ঘরে গিয়েছিলাম। কেউ

একটা রাতের জন্য ঠাঁই দিতে চায়নি। এই ছোট্ট কুঁড়েঘরে দুজনের থাকতেই কষ্ট। অথচ আপনারা আমাকে ভিখারি নয়, অতিথির মতোই আশ্রয় দিলেন। সেটা ভেবেই…
কাঠুরে বললেন, ছিঃ ছিঃ। অমন কথা মুখেও আনতে নেই। দরজায় টোকা শুনে অতিথির কথা ভেবে আমরা খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু অতিথিকে দেখে হতাশ হয়েছি।
শিশু অতিথি বলল, কেন?
কাঠুরে বললেন, আমাদের অতিথি এত্তোটুকুন বলে। প্রথমে দরজা খুলে তো আমি নিচের দিকেই তাকাইনি। অথচ…। সে যাই হোক অতিথি পেয়েই আমরা খুশি। এখন যত্তোটুকুনই হোক। আমাদের কাছে অতিথি মানেই যিশু।

অনেক সময় নিয়ে রাতের খাবার সারলেন কাঠুরে আর তার বউ। খাবারের পর নিজেদের বিছানাটা ছেড়ে দিলেন অতিথিকে। গরম কাপড় দিয়ে ভালো করে শরীর ঢেকে দিলেন, যাতে ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে অতিথির কষ্ট না হয়। আর নিজেরা শরীর ভাঁজ করে বসে রইলেন আগুনের পাশে। সারারাত। বসে বসেই ঘুমোলেন। ঘুম ভাঙলো সেই ভোরে। কাঠুরের তখন কাঠ কাঠতে যাওয়ার সময়। প্রতিদিন এমন ভোরেই ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ঘুম ভাঙতেই দেখলেন অতিথি বসে আছে বিছানার উপর। যেন তাদের ঘুম ভাঙার অপেক্ষাতেই ছিলো। কাঠুরেকে জাগতে দেখেই বললো, আমি এখন যাবো। মা কি

ঘুমুচ্ছেন?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে পড়লেন কাঠুরে বউ। বললেন, এখন যাবে কোথায়?
অতিথি শিশু বললো, অ-নে-ক দূর।
কাঠুরে জানতে চাইলেন, আমাদের এখানেই থেকে যাওনা? আমি তোমার মা হবো। তোমার মা নেই?
অতিথি শিশু বললো, আছেন।
কাঠুরে বউ আবার জানতে চাইলেন, তোমার ঘর নেই?
অতিথি শিশু বললো, এই দুনিয়াটাই আমার ঘর।
বলেই বিছানা থেকে নামলো। তারপর কাঠুরের হাতে একটা ডাল দিয়ে বললো, এটা ঘরের আঙিনায় লাগিয়ে দেবেন।
তারপর ঘরের দরজা খুলে নিজেই বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেলো?

jongol

ডালখানা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে উঁকি-ঝুকি মারলেন কাঠুরে। দেখতে পেলেন না কাউকে। কাঠুরে বউও এদিক ওদিক তাকালেন। কারুর চিহ্নটি পেলেন না।
কোনোরকমে ডালখানা মাটিতে পুঁতে কাঠ কাটতে বেরিয়ে গেলেন কাঠুরে।
তারপর চলে গেলো অনেক দিন। প্রতি রাতে খাবারের সময় সেই অতিথির কথা ভাবেন কাঠুরে আর কাঠুরে বউ। কোনোদিন দরজায় একটু খানি শব্দ হলেই ছুটে যান কাঠুরে বউ। দরজা খুলে বাইরে তাকান। উপরে-নিচে, ডানে-বামে। নাহ্। এমনিই শব্দ। কোনো অতিথির দেখা মেলে না। গহীন অরণ্যে কাঠুরেদের এই ছোট্ট ঘরখানায় অতিথি হতে অতিথিদের বয়েই গেছে!
দেখতে দেখতে বড়দিন চলে এলো। বড়দিনের আগের রাতে খেতে বসে কেন যেন সেই অতিথির কথা খুব মনে পড়ছে তাদের। কাঠুরে বউ বললেন, আমাদের সেদিনের অতিথির কথা মনে আছে তোমার? তার পরিচয়টাই তো জানা হলো না আজো।
কাঠুরে বললেন, অতিথির পরিচয় জানতে চাওয়া ঠিক নয়। অতিথি তো অতিথিই। সে যে-ই হোক।
কাঠুরে বউ বললেন, তবু। ওকে আগে কখনো কোথাও দেখেছিলে?
কাঠুরে বললেন, নাহ্। আবার খুব চেনা চেনাও লাগছিলো।

আলাপে আলাপে রাতের খাবার সেরে ফেললেন দুজন। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আগামীকাল বড়দিন। সকাল সকাল গির্জায় যেতে হবে প্রার্থনা করতে। সবচেয়ে কাছের গির্জাটাও এখান থেকে অনেক দূর।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই কাঠুরে বললেন, মেরি ক্রিসমাস।
কাঠুরে বউও বললেন, মেরি ক্রিসমাস।
বিছানা থেকে বাইরে এলেন কাঠুরে বউ। আর কাঠুরে তখনও আড়মোড়া ভাঙছিলেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দেয়ার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু কাঠুরে বউয়ের চিৎকারে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে চলে এলেন বাইরে। বললেন, এত চেঁচাচ্ছো কেন?
কাঠুরে বউ কিছু না বলে আঙুল দিয়ে দেখালেন। কী দেখালেন?
উঠানে গাছটা দেখেই কাঠুরে অবাক হয়ে বললেন, এটা তো সেই গাছটা। মনে আছে তোমার?
কাঠুরে বউ মাথা নাড়লেন, খুব মনে আছে তার। সেই সকালের কথা। এমনি এক সকাল ছিল তখন। সেই অতিথি শিশু ডালটা দিয়েছিল কাঠুরের হাতে। তারপর সেই ডালটা যে এতবড় একটা গাছ হয়ে যাবে কে ভেবেছিল? আর ওই গাছটি যে সোনালি আপেলে ভরে থাকবে, কে জানতো? কাঠুরে বউয়ের কতদিনের শখ ছিল, ক্রিসমাসের দিন আপেলের পাই খাবেন। কিন্তু তার গোপন ইচ্ছের কথা সেই অতিথি জানলো কেমন করে? তাহলে কি সেদিনের সেই অতিথি সামান্য একজন অতিথি ছিলেন না? তবে কি স্বয়ং যিশু অতিথি হয়ে তাদের এই ভাঙা কুটিরে এসেছিলেন? তাহলে সেই রাতে যে শিশু অতিথি হয়ে তাদের সেবা নিয়েছিলেন, সেই শিশুই তাহলে যিশু!
নয় তো কি!

(গ্রীক উপকথা অবলম্বনে)

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *