জীবনের ছন্দ ঠিক রাখতে ঘুম যে জরুরি, তা সবাই মানেন। শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি তো রয়েছেই, স্বাস্থ্যসম্মত ঘুম আয়ুও বাড়িয়ে দেয়।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে অনেক কিছুতেই গড়বড় হয়ে যায়। নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, নির্ঘুম রাত মানুষের আচরণ এতটাই বদলে যায় যে, কেউ কেউ ভীষণ স্বার্থপরও হয়ে উঠতে পারেন।
পিএলওএস বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণার বরাতে সিএনএন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, অন্যের উপকার করার যে মানসিকতা, তাতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে অপর্যাপ্ত ঘুম।
বার্কেলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি গবেষণা করে দেখেছেন। কম ঘুমালে ’স্বার্থপরতা’ বাড়ে কি না, তা দেখাই ছিল গবেষণার বিষয়।
মানুষ অন্যের উপকার করার কথা চিন্তা করার সময় তার মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ যেমন থাকে, ঘুমের সামান্যতম ঘাটতিও সেই চিন্তা প্রক্রিয়ার প্রভাব ফেলতে পারে।
এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ইউসি বার্কেলের স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর হিউম্যান স্লিপ সায়েন্সের পরিচালক ম্যাথিউ ওয়াকার এবং বিজ্ঞানী ইটি বেন সায়মন। সিএনএনকে তারা বলেছেন, গবেষণায় যে ফলাফল তারা হাতে পেয়েছেন, তা ‘বিস্ময়কর’।
বেন সায়মন বলেন, ”মানুষকে সহায়তা করার যে মানসিকতা, তাতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে এক ঘণ্টা কম ঘুম হওয়াই যথেষ্ট। ঘুমের ওই এক ঘণ্টার ঘাটতিও মানুষের সদয় মনকে বদলে দিতে পারে।”
এ গবেষণায় ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৩০ লাখ দানের ডেটাবেজ নিয়ে কাজ করেছেন বেন সাইমন, ম্যাথিউ ওয়াকার এবং তাদের সহকর্মীরা।
যখন ’ডে লাইট সেভিং টাইম’ চালু থাকে, সে সময় দানের পরিমাণ ১০ শতাংশ কমে যেতে দেখেছেন তারা।
কিন্তু যেসব এলাকায় ঘড়ির সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়া হয়নি, সেখানে দানের পরিমাণে ঘাটতি দেখা যায়নি।
আরেকটি গবেষণা করা হয় ২৪ জন মানুষকে নিয়ে। আট ঘণ্টার ঘুমের পর তাদের মস্তিষ্কে ফাংশনাল এমআরআই পরীক্ষা চালিয়ে দেখা হয়। একই পরীক্ষা করা হয় ওই ২৪ জনকে এক রাত নির্ঘুম রেখে।
মস্তিষ্কের প্রোসোশাল নিউরাল নেটওয়ার্ক মানবিক আচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের ঘাটতি হওয়ায় প্রোসোশাল নিউরাল নেটওয়ার্ক কম সক্রিয় থাকছে।
‘থিওরি অব মাইন্ড’ হল সেই সক্ষমতা, যার কারণে একজন আরেকজনের চাহিদা, পরিস্থিতি, আবেগকে উপলব্ধি করতে পারে। এই ‘থিওরি অফ মাইন্ড’ শৈশব থেকে সামাজিক মেলামেশার মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে।
যুক্তরাজ্যে গাইস অ্যান্ড সেইন্ট টমাস হসপিটালের স্লিপ ফিজিশিয়ান ও নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট ইভানা রোসেনভিগ বলেন, “ঘুম আমাদের মনের দশা ও আমাদের কগনিটিভ ফাংশনে প্রভাব ফেলে। আর এভাবেই আমরা বাকি সবার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করি তাতেও প্রভাব ফেলে ঘুম।”
একশ মানুষের তিন-চার দিনের ঘুম মেপে দেখা হয়েছে তৃতীয় গবেষণায়।
তাতে গবেষকরা দেখেছেন, কতক্ষণ ঘুমানো হচ্ছে, তার চেয়ে আরামদায়ক ঘুম হল কিনা সেটিই বেশি অর্থ বহন করে মানুষের স্বার্থপর হয়ে ওঠার মত আচরণে।
যারা গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন, তাদের করা প্রশ্নের জবাব থেকেই গবেষকরা স্বার্থপর আচরণের পরিমাপ করেন।
বেন সাইমন বলেন, পরিমাণমাফিক ও আরামদায়ক ঘুম- দুটোই মানুষের আবেগ ও সামাজিক আচরণে ছাপ ফেলে; তাই গবেষকরা তা থেকে আচরণগত প্রভাব দেখার প্রত্যাশা করছিলেন।
“ঘুমের পরিমাণ আরো খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়ার পর ওই ঘুমের আরামবোধ হচ্ছে জরুরি, যা কি না আমাদের অপর কাউকে সাহায্য করার ইচ্ছেকে জাগিয়ে রাখে।”
কিংস কলেজ লন্ডনের ব্রেইন প্ল্যাস্টিসিটি সেন্টারের প্রধান রোসেনভিগ সিএনএনকে বলেন, “পর্যাপ্ত ও আরামদায়ক ঘুম আমাদের সামাজিক আচরণ ও মস্তিষ্কের তৎপরতায় ভারসাম্য আনে, মানবিক করে তোলে।”
উন্নত দেশের অর্ধেক মানুষই বলে থাকেন, সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে তাদের পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। ওয়াকার একে বলছেন ‘বৈশ্বিক ঘুম ঘাটতির মহামারী’।
এরই মধ্যে অনেক গবেষণাই হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, ঘুমের ঘাটতি মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ডেকে আনে; দেখা দেয় অস্থিরতা ও অবসাদ। ডায়াবেটিস ও স্থূলতা তো রয়েছেই।
ঘুমের ঘাটতি আচরণে কতটা বিরূপ ছাপ ফেলে, নতুন গবেষণায় তারই ইংগিত মিললো বলে মনে করছেন ওয়াকার।
বেন সায়মন ও ওয়াকার দুজনই মনে করছেন, এই গবেষণা ঘুম নিয়ে মানুষকে আরও সচেতন করবে।