ডোরাকাটা জেব্রা

জেব্রা
জেব্রা

তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছো, যে জেব্রা চেনো না? আরে, ঐ যে ঘোড়ার মতো প্রাণীটা, যার সারা গায়ে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ। ওদের গায়ের মতো সাদা-কালো ডোরা এঁকে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেই তো ওর নাম জেব্রা ক্রসিং! আর যারা তবু চিনছো না, ‘মাদাগাস্কার’ দেখা আছে না তোমাদের? কিংবা ‘রেসিং স্ট্রিপ’? ওখানে ঘোড়ার মতো গায়ে ডোরাকাটা দাগওয়ালা একটা প্রাণী আছে না? আরে, ও-ই তো জেব্রা! এবার চিনেছো তো?

 

এই জেব্রাদের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্যই কিন্তু তাদের গায়ের ওই ডোরাকাটা দাগগুলো। মজার ব্যাপার কি জানো? আমরা জেব্রাদের কি বলি, বলো তো? কালো কালো ডোরাওয়ালা সাদা ঘোড়ার মতো একটা প্রাণী, তাই না? আফ্রিকানরা কিন্তু এর একদমই উল্টো চিন্তা করে। ওদের ধারণা, জেব্রা হলো একটা কালো প্রাণী, যাদের সারা গায়ে সাদা সাদা ডোরাকাটা দাগ আছে!

জেব্রা
জেব্রা

আচ্ছা, তোমাদের মনে কি কখনো এই প্রশ্ন হয়নি, জেব্রাদের গায়ে এরকম ডোরাকাটা দাগ কেন থাকে? আর যদি বা থাকলোই, সেই ডোরাকাটা কেনো-ই বা সাদাকালো? তা-ও তো কথা! বিজ্ঞানীরাও এ ব্যাপারে বেশ ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন। চিন্তায় চিন্তায় তো তাদের মাথার চুল পড়ে যাবার উপক্রম! পরে শেষমেশ তারা এই ডোরাকাটার কয়েকটা ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন। কি, শুনবে নাকি সে সব ব্যাখ্যা?

অনেক বিজ্ঞানীর মতে, জেব্রার এই ডোরাকাটা দাগগুলো আসলে ওদের ছদ্মবেশের জন্য। ওই দাগের কারণে আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে ওরা সে সব প্রাণীদের চোখে ধুলো দেয়, যারা ওদের ধরে ধরে মেরে খেয়ে ফেলে। ভাবছো, তাহলে নিশ্চয়ই আফ্রিকার বনের ঘাস-গাছপালাগুলো সাদাকালো! নইলে সাদাকালো ডোরাকাটা দাগ দিয়ে ছদ্মবেশ হয় কিভাবে? উহু, আসলে ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। জেব্রার আসল শত্রæ কারা জানো? সিংহ। ওরাই মূলত জেব্রাদের ধরে ধরে খায়। আর এই সিংহরা কিন্তু কালার ব্লাইন্ড, বাংলায় বললে বর্ণান্ধ! মানে বিভিন্ন রং আলাদা করে চিনতে পারে না। ওদের জগতটাই সাদাকালো! কোনোটা গাঢ় কালো, কোনোটা হালকা কালো, কোনোটা গাঢ় সাদা আবার কোনোটা হালকা সাদা। সেই সিংহের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য তো সাদাকালো ডোরাকাটাই সবচেয়ে ভালো, তাই না?

যারা জেব্রাদের সম্পর্কে অল্প-বিস্তর খোঁজখবর রাখো, তোমরা তো এবার ধাঁ করে জিজ্ঞেস করে বসবে, জেব্রা’রা তো সবসময়ই দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। তখন কি আর এই ক্যামোফ্লেজ, মানে ছদ্মবেশ কাজে লাগে? আসলে এই ডোরাকাটা ছদ্মবেশ সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে তখনই। কারণ, ওরা যখন দল বেঁধে ঘোরে, তখন ওরা একজন আরেকজনের এতোই কাছে থাকে, সিংহরা বুঝতেই পারে না যে ওগুলো আসলে জেব্রার একটা বিশাল পাল! ওদের কাছে মনে হয়, এটা একটা বিশাল আকারের অদ্ভূত কোনো জন্তু বা অন্য কিছু, যেটা অনবরত নড়ছে। এমনকি, যদি কোনোভাবে বুঝতেও পারে যে এটা আসলে জেব্রার একটা বিশাল দল, তখনও সমস্যা থেকেই যায়। সিংহ যে বুঝতেই পারে না, কোন জেব্রাটা কোনদিকে যাচ্ছে! আর তাই জেব্রাদের শিকার করতেও ওদের খুব সমস্যা হয়। তাহলেই বলো, এই ডোরাকাটা দাগ জেব্রাদের জন্য কতোই না গুরুত্বপূর্ণ!

এই ডোরাকাটা দাগের আরো ব্যবহার আছে। এই ডোরাকাটা দাগ কিন্তু আমাদের আঙুলের ছাপের মতোই। জানো নিশ্চয়ই, মানুষের আঙুলের ছাপ কারো সঙ্গেই কারোটা মেলে না। তোমার আঙুলে যে ঘোরানো-প্যাঁচানো দাগগুলো আছে, আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিলে যেগুলো কাগজে দাগ ফেলে, সেগুলো কিন্তু যাকে বলে ইউনিক; তোমার আঙুলের দাগগুলোর নকশার সঙ্গে আর কারো আঙুলের নকশা মিলবে না। সেরকম জেব্রাদের এই ডোরাকাটা দাগগুলোও অনন্য বা ইউনিক; কোনো জেব্রার গায়ের ডোরাকাটা দাগের সঙ্গে অন্য কোনো জেব্রার ডোরাকাটা দাগ মিলবে না। আর তাই আমরা যেমন অন্যদের মুখ-চোখ-চুল দেখে চিনতে পারি, তেমনি এক জেব্রা অন্য জেব্রাকে চেনে তার গায়ের ডোরাকাটা দাগ দেখে। কিন্তু আমরা আবার সেটা পারি না, আমাদের কাছে সব জেব্রাকেই দেখতে এক রকম লাগে। আর তাই তো ‘মাদাগাস্কার’ ছবিতে অ্যালেক্স দ্য লায়ন তার প্রিয় জেব্রা বন্ধু মার্টিকে জেব্রাদের পালের মধ্যে গিয়ে আর চিনতে পারে না!

এই ডোরাকাটা দাগের কিন্তু আরো একটা ব্যবহার আছে। এই ব্যবহারও এক রকমের ছদ্মবেশ-ই বলতে পারো। এই ছদ্মবেশও এক ভয়ংকর প্রাণীর কাছ থেকেই জেব্রাদের লুকোতে সহায়তা করে। সেই ভয়ংকর প্রাণীর নাম শুনবে? টেটসি মাছি! মাছি হলে কি হবে, রক্তখেকো হিসেবে কিন্তু এদের বেশ দুর্নাম আছে। সবাই ওদেরকে একনামে বলে- ‘ব্লাড সাকার’!

জেব্রা
জেব্রা

জেব্রাদের বিশেষত্ব শুধু তাদের গায়ের ডোরাকাটা দাগেই সীমাবদ্ধ নয়, ওদের কিন্তু দেখার, শোনার এবং গন্ধ শোঁকার ক্ষমতাও খুব ভালো। ওদের চোখ কিন্তু আমাদের মতো সামনের দিকে না, মুখের দুই পাশে। তাই ওরা চারপাশে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে দেখতে পারে। আর বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওরা সিংহের মতো বর্ণান্ধও নয়, ওরা রংও দেখতে পারে। শুধু তাই না, ওদের চোখের একটা বিশেষ ক্ষমতাও আছে; ওরা রাতেও বেশ ভালোই দেখতে পায়! তবে অন্যান্য প্রিডেটরদের মতো ওদের এই ‘নাইট ভিশন’ অতোটা ভালো না। তবু দেখতে তো পায়; আমাদের মতো রাত হলেই টর্চ জ্বালিয়ে তো আর ঘুরতে হয় না!

ওরা কিন্তু খুব ভালো শুনতেও পারে। না, শিক্ষকদের লেকচার শুনতে ওরা তেমন পছন্দ করে না, কিন্তু ওদের কানের শ্রবণক্ষমতা এত্তো প্রখর! আর ওদের কান ঘোড়ার কানের চেয়েও বেশ বড়োসড়ো। আর ঘোড়ার মতো ওরাও যেদিকে ইচ্ছা কান ঘোরাতে পারে, তাই যেদিক থেকে শব্দ আসছে সেদিকে কান ঘুরিয়ে ওরা শব্দটা চাইলে আরো ভালো করে মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে। একবার ভাবো, আমাদের কান এরকম হলে কতো মজা হতো! শিক্ষকের লেকচার বোরিং লাগলে আমরা কান ঘুরিয়ে মজাসে বসে থাকতে পারতাম!

না হয় জেব্রারা খুব ভালো দেখতে আর শুনতে পারে, তাই বলে তো আর ওরা আমাদের মতো কথা বলতে পারে না! তাহলে ওরা একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিভাবে বলো তো? হুঁ হুঁ, এরও ব্যবস্থা আছে। ওরা আবার ঘোড়া গোত্রের প্রাণী কিনা, ঘোড়ার মতো ডাক দিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে। আর শুধু ডাক দিয়েই ওরা যোগাযোগ করে না, ওদের কানও কিন্তু ওদের ভাব প্রকাশের খুব ভালো একটা মাধ্যম। ওরা যখন শান্ত থাকে, তখন ওদের কানও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। কিন্তু যখনই ভয় পায়, ওদের কান সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর রেগে গেলে হয় উল্টোটা, পিছের দিকে হেলে যায়। আর যখন আশেপাশে কোনো শিকারি আছে কিনা, মানে সিংহ আছে কিনা তার খোঁজ করে, তখন একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে সিংহের পায়ের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করে। ওই কান খাড়া করে শোনা বলে একটা বাগধারা আছে না, জেব্রারা আক্ষরিক অর্থেই সেটা করে আরকি! আর যদি আশেপাশে কোনো সিংহের খোঁজ পায়, তাহলেই হয়েছে। যতো জোরে পারে চেঁচাতে থাকে।

আচ্ছা, তোমার যদি একটা পোষা জেব্রা থাকতো, তাহলে কেমন হতো, বলো তো? পোষ মানাতে পারলে জেব্রা কিন্তু ঘোড়ার চেয়েও বেশি কাজের হতে পারে। কারণ, আফ্রিকার আবহাওয়া ঘোড়ার চেয়ে জেব্রাই তো ভালো চেনে। আর ঘোড়ার চেয়ে জেব্রা অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, জেব্রা জাতে বুনো প্রাণী। ওরা পোষ মানতেই চায় না। ওরা চায় বনের মুক্ত অ্যাডভেঞ্চারাস জীবন, যেখানে প্রতি পদে পদে সিংহের শিকার হওয়ার ভয় আছে, আবার বিশাল মাঠে উদ্দাম ছুটে চলার আনন্দও আছে। কিন্তু তাই বলে কি আর মানুষ বসে থাকবে! কিছু মানুষ কিন্তু ঠিকই জেব্রাকেও পোষ মানিয়েছিলো। দক্ষিণ আফ্রিকার এক গভর্নর জর্জ গ্রে তো জেব্রা ব্যবহার করতেনই, সেখান থেকে যখন তাঁকে নিউজিল্যান্ডে বদলি করা হলো, তখন তিনি তাঁর পোষা জেব্রাগুলোকেও নিয়ে যান নিউজিল্যান্ডে!

এই জেব্রা কিন্তু আফ্রিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রাণী। ওকে নিয়ে যে ওখানকার মানুষের কতো আগ্রহ! আফ্রিকার রূপকথা আর লোককাহিনীগুলো পড়লেই বুঝবে, জেব্রাকে নিয়ে ওদের কতো জল্পনা-কল্পনা। আমাদের রূপকথা-লোককাহিনীতে যেরকম বাঘ-ভাল্লুক, কুকুর-বিড়াল, গরু-ছাগল-মুরগি’রা কথা বলে, গান করে, তেমনি ওদের রূপকথা-লোককাহিনীর একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এই জেব্রা। ওদের গায়ের সাদা-কালো ডোরাকাটা নিয়েও কতো রূপকথা আর লোককাহিনী-ই না আছে! নামিবিয়ার এরকম একটা গল্প শোনো-

আগে জেব্রার গায়ে কোনো ডোরাকাটা দাগই ছিলো না। ওদের গায়ের রং ছিলো সাদা। তো একবার কি করতে কি করতে বেবুনের সঙ্গে ওর লাগলো ভীষণ মারামারি। সে কী লড়াই! একবার বেবুন জেব্রাকে কোণঠাসা করে ফেলে তো পরক্ষণেই জেব্রা একেবারে বেবুনকে শুইয়ে তার উপর চড়ে বসে। তো মারামারি করতে করতে জেব্রা একবার বেবুনকে একদম বাগে পেয়ে গেলো। আর পেয়েই তো উল্টো ঘুরে পেছনের জোড়া পা দিয়ে গায়ের জোরে দিলো ভীষণ এক লাত্থি। বেবুন তো উড়ে গিয়ে পড়লো। কিন্তু এত্তো জোরে লাথি মেরে জেব্রাও নিজের ভারসাম্য রাখতে পারলো না, নিজেই পড়ে গেলো পাশের এক অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই সে উঠে পড়লো; কিন্তু এরমধ্যেই যা হওয়ার হয়ে গেলো। জেব্রার সুন্দর সাদা কোটের মতো চামড়া আগুনে পুড়ে গেলো। ওর সাদা গায়ে কালো কালো ডোরাকাটা দাগ পড়ে গেলো। তখন থেকেই জেব্রার গায়ে এই সাদাকালো ডোরাকাটা দাগ। কেমন মজার না গল্পটা?

কেমন লাগলো এই ডোরাকাটা জেব্রার গল্প শুনতে? চাইলে তোমরা একে ডোরাকাটা ঘোড়াও বলতে পারো। কেন, বলেছি না, জেব্রা ঘোড়া গোত্রেরই একটা প্রাণী! চাই নাকি এরকম একটা ঘোড়া, থুক্কু জেব্রা?

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *