মেয়েকে বোঝাতে হবে সতর্কতা কতটা জরুরি। বুঝিয়ে দিতে হবে, মানুষ চিনতে শেখা কতটা দরকার।
মানছি, মাঝে মাঝে নিজেদেরও এটা বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে সব খবরের মাঝে বাস করি আমরা, তাতে সেটা অস্বাভাবিকও নয়। বিশেষ করে যাঁরা টিনএজার মেয়েদের বাবা-মা, তাঁরা যে দুশ্চিন্তায় ভুগবেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ আশপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বাস্তব পৃথিবীই হোক বা ভার্চুয়াল জগৎ,
মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব সিরিয়াসলি ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে। এরকম অবস্থায় কেউই কী করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে বলুন? কিন্তু আপনাদের তো দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়লে চলবে না। আপনাদের মেয়েও তো চারপাশের অবস্থা দেখছে, বুঝছে। ভয় কিন্তু সে-ও পাচ্ছে। আপনারাও যদি ভেঙে পড়েন, মেয়েকে কে বোঝাবে? তাকে বোঝাতে হবে সতর্কতা কতটা জরুরি। বুঝিয়ে দিতে হবে, মানুষ চিনতে শেখা কতটা দরকার। আর সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েদের মনে এই বিশ্বাসের ভিত গড়ে দিতে হবে যে, ভাল-খারাপ সর্বত্রই থাকে। কিন্তু পৃথিবীটা আসলে ভাল জায়গাই!
- প্রথম কথা… যেটাকে বাবা-মা এবং যে কোন বয়সি ছেলেমেয়ের সম্পর্কের থাম্বরুল বলা যায়… তা হল, সন্তানের বন্ধু হয়ে ওঠা। এই অভ্যেসটা যদি ছোটবেলা থেকে করে ফেলতে পারেন, যদি ছোট থেকেই সন্তানের জীবনে কী ঘটছে,
- তা নিয়ে সে আপনার সঙ্গে গল্পগুজব করতে পারে, তাহলে টিন-এজে পৌঁছেও তার সেই অভ্যেস থেকে যাবে। কার সঙ্গে সে মিশছে, কারা তার প্রতি ‘অ্যাডমিরেশন’ দেখাচ্ছে,
- বা কেউ কোনওভাবে তার বিরক্তি বা অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে কি না…
- কোনওকিছুই আপনাদের বলতে সে দ্বিধা করবে না। সম্পর্কে এই স্বচ্ছতাটা সকলের আগে দরকার। সন্তানের বোঝা দরকার, যে আপনারা তার বন্ধু। আপনাদের কাছ থেকে কিছু লুকনোর কোনও দরকার নেই তার। বিশেষ করে, কারও কোনও ব্যবহারে যদি আপনাদের মেয়ে অস্বচ্ছন্দ বোধ করে,
- আপনাদের সে কথা খোলাখুলি বলার মতো কমফর্ট যেন সে পায়। ওকে বুঝিয়ে দিন যে আপনারা সবসময়, সব অবস্থায় ওর পাশে রয়েছেন।
- পৃথিবীর আর পাঁচটা জিনিসের মতো সোশ্যাল মিডিয়ারও ভাল-খারাপ দু’দিকই রয়েছে। আর এর আকর্ষণ এমনই অমোঘ, যে এড়ানো যায় না। এড়াতে বলা উচিতও নয়। খালি একটু খেয়াল রাখুন, কারও সঙ্গে আপনার মেয়ের ভার্চুয়ালি বেশি বন্ধুত্ব হচ্ছে কি না। সে যতটা সময় সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়, তার চেয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছে কি না। অনেক রাত পর্যন্ত ফোন বা ল্যাপটপে আটকে রয়েছে কি না। যদি মেয়ে এমনিতে আপনাদের সব বলে কিন্তু দেখেন এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছে…
- তাহলে কিন্তু এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।
- তা বলে হেলিকপ্টারিং করবেন না। বকাবকি তো করবেন না-ই। যদি মেয়ের কোনও ব্যবহার স্বাভাবিকের চেয়ে আলাদা লাগে, তার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলুন। গল্পে গল্পে জানতে চান, তার সঙ্গে নতুন কারও বন্ধুত্ব হয়েছে কি না। নতুন বন্ধুর সম্পর্কে কতটা জানে সে। যে তথ্যগুলো সেই বন্ধু নিজের সম্পর্কে বলছে বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে দিয়েছে, সেগুলো আর-একবার খুঁটিয়ে দেখে নেওয়ার পরামর্শ দিন। ‘তুই কিছু বুঝিস না’ জাতীয় কথা বলবেন না মেয়েকে। বরং তাকে বোঝান, যে তার বিচারবুদ্ধির উপর আপনাদের আস্থা রয়েছে। খালি চারপাশে বিপদের ভয় এত বেশি বলেই একটু বাড়তি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তা হলে দেখবেন, মেয়েও আপনাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতেই আরও সতর্ক হবে।
- কোথায় কী ঘটছে, কোনখানে অসতর্ক হলে বিপদে পড়তে হতে পারে…
- ইনফরমেশন বুমের কল্যাণে এসব তথ্য পেতে এখন আর আমাদের কোনওই অসুবিধা হয় না। খেয়াল রাখুন, মেয়ে যেন এগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে। টিন-এজার মানে অনেকটাই বড় হয়েছে সে। যথেষ্ট বুদ্ধিমতীও। যদি চোখ-কান খোলা রাখে, তাহলে পরিস্থিতির গুরুত্ব নিজেই বুঝবে। আর সেটা যাতে রাখে,
- বাবা-মা হিসেবে তা দেখা আপনাদের দায়িত্ব। প্রয়োজন পড়লে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাড়ির সকলে আলোচনাও করতে পারেন মাঝে মাঝে। কিন্তু আলোচনার সুর কীরকম হবে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। অতিমারি এবং ইচ্ছেমতো বাইরে বেরতে না পারার কারণে পরিস্থিতি এমনিই উদ্বেগে,
- বিষণ্ণতায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে। আপনাদের কথায় যেন আপনাদের সন্তান আরও বেশি ভয়ের, বিষণ্ণতার শিকার না হয়ে পড়ে। সাবধানতা আর ভয়ের মাঝখানে একটা না-সরু, না-চওড়া গণ্ডি রয়েছে।
- সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া আপনাদের দায়িত্ব।
- সবচেয়ে বড় কথা… সন্তানকে রুখে দাঁড়াতে শেখান। সে নিজে যদি কখনও, কোথাও, কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়ে, বা অন্য কাউকে পড়তে দেখে,
- তবে যেন এড়িয়ে না যায়, পালিয়ে না যায়। যারা অন্যায় করছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন রুখে দাঁড়ায়। এই লোকগুলো আসলে এতটাই ভিতু হয়, যে একসঙ্গে গর্জে উঠলে পালানোর পথ পায় না। শারীরিকভাবে কোনও বিপদে পড়লে আত্মরক্ষার জন্য কী কী করতে হবে,
- এ ব্যাপারে আপনার মেয়ের যেন স্পষ্ট ধারণা থাকে। অনেক জায়গাতেই সেলফ-ডিফেন্সের ক্লাস হয়। প্রয়োজন বুঝলে তেমন কোথাও ভর্তি করে দিতে পারেন মেয়েকে। ব্যাগে পেপার স্প্রে রাখা, স্পিড ডায়ালে জরুরি নম্বরগুলো সেভ করে রাখা, অ্যাপ-ক্যাবে উঠলে লোকেশন শেয়ার করা… ইত্যাদি বিষয়গুলো যেন সে মাথায় রাখে। মেয়েকে বুঝতে দিন, যে তার নিরাপত্তার চেয়ে বড় আপনাদের কাছে আর কিছু নয়। দিনের শেষে তার হাসিমুখ দেখার জন্য আপনারা সারাদিন অপেক্ষা করে থাকেন।
- তাহলেই দেখবেন, সে-ও সচেতন থাকবে।
শেষে একটাই কথা বলার, যা এই লেখার শিরোনাম। চারপাশে কিছু খুব খারাপ ঘটনা ঘটছে ঠিকই। কিন্তু তার মানে পৃথিবীটাই খারাপ, এমন নয়। এই বিশ্বাসটা আপনার মেয়ের মনে এখনই তৈরি করে দেওয়া দরকার।
টিন-এজেই বাইরের জগতে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা বাড়ে। এখন থেকে যদি গোটা পৃথিবীকেই খারাপ ভেবে নেয়, অবিশ্বাস করতে শুরু করে,
ভাবুন তো ওর জীবন কীরকম কষ্টের হয়ে উঠবে! তাই দুনিয়ার কালো, সাদা, ধূসর…
সব রঙের সঙ্গেই পরিচয় হোক আপনাদের মেয়ের। ও বড় হোক নিজের মতো। নিজের আনন্দে।