বাতায়ন পত্রিকার সম্পাদক ফোন করে আবারও তাড়া দিল লেখার জন্য।
‘তমাল, আমাদের কম্পোজ শেষ, পরশু থেকে
মেকআপ শুরু হবে। তোমার লেখাটাই শুধু বাকি। একটু তাড়াতাড়ি করো না ভাইয়া।’
গত দু’দিনে ভুলেই গিয়ে ছিলাম এই লেখাটার কথা। সেটা প্রকাশ না করে বললাম, ‘ঠিক আছে ভাই আমি কালকের মধ্যেই লেখা পাঠাবো।’
বাতায়ন মফস্বলের একটি শিশু-কিশোর পত্রিকা। দ্বি-মাসিক। এর মধ্যে ভালোই নাম করেছে। মফস্বল শহর থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ ও তার ধা
রাবাহিকতা রক্ষা খুবই কঠিন। সে হিসেবে বাতায়ন খুব ভালো ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।
শুধু আমার একটা লেখার জন্য পত্রিকার কাজ আটকে থাকবে ভাবতে খারাপ লাগলো। দুপুরে খাবার পরে বিশ্রাম না নিয়ে লিখতে বসলাম। লেখাটা শুরু করেছিলাম সপ্তাহ খানেক আগে। সায়েন্স ফিকশন। প্রায় অর্ধেকটা লিখে রেখেছি। নানা ঝামেলায় আর লেখা হয়নি। সম্পাদকের তাড়া না খেলে আজও বসা হত কিনা সন্দেহ। আগের লেখাটুকু পড়ে কয়েক মিনিট চিন্তা করলাম। মনে মনে শেষের অংশটা ঠিক করে আবার কলম চালাতে শুরু করলাম। গল্পটা একটি এলিয়েনকে নিয়ে।
শিশু এলিয়েন। নাম নুডাস। নুডাসিন গ্রহের বাসিন্দা সে। পৃথিবীতে এসেছে একা। পৃথিবীর শিশুদের প্রতি অদম্য কৌতুহলের কারণে সে এসেছে পৃথিবীর শিশুদের দেখতে। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুড়ে শিশুদের দেখে নুডাস। ভালো লাগে তাদের। বিভিন্নভাবে পৃথিবীর শিশুদের সাথে মিশতেও চেষ্টা করে। এ সময় পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের নজরে পড়ে যায় নুডাস। কিছু বিজ্ঞানী নুডাসকে ধরতে চেষ্টা করে। বিজ্ঞানীদের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় নুডাস। কয়েকদিন পৃথিবীতে অবস্থানের পর চলে যায় নিজ গ্রহে।’
একটানা লিখে চললাম। আধাঘন্টার মধ্যেই শেষ হলো লেখা। কয়েকবার পড়ে ছোট খাট ভুলগুলো ঠিক করলাম। এখন বাইরে গিয়ে দোকান থেকে কম্পোজ করে ই-মেইল করতে হবে। বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময় আমার রুমের দরজায় ঠক্ ঠক্ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি আমার বয়সি একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে। চিনতে পারলাম না। আগে কখনও দেখিনি তাকে।
জানতে চাইলাম, ‘কে তুমি?
ছেলেটি বললো, ‘ভিতরে আসবো?’
‘এসো।’
ভিতরে এসে আমার টেবিলের পাশে বেডে বসলো ছেলেটি।
‘কিছু মনে করো না, তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম আমি।
আমার কথা ছেলেটি শুনেছে কিনা বুঝতে পারলাম না। কোন জবাব দিলো না। আমার দিকে চেয়ে বললো, ‘তুমি তমাল?’
‘হ্যাঁ, আমি তো তমালই; কিন্তু তুমি কে?
এবারও আমার কথার জবাব দিলো না ছেলেটি। বরং হাত দিয়ে টেবিল থেকে আমার নতুন লেখাটি তুলে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। এবার আমি ভালো করে তাকালাম ছেলেটির দিকে। আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। চেহারাটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। স্বাভাবিকের মাঝেও কোথায় যেন একটু বৈচিত্র আছে; কিন্ত সেটা চোখে পড়ছে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম আমি। সুন্দর সোনালী চুল, নীলচে চোখ… হ্যাঁ এবার চোখে পড়েছে, ছেলেটার কান দুটো অস্বাভাবিক রকমের ছোট। তাকিয়ে রইলাম একই ভাবে।
ছেলেটি আমার নতুন লেখাটা দেখছে একমনে। মেজাজটা বিগড়ে গেল। আমি সাধারণত আমার নতুন লেখা কাউকে দেখাই না। অন্তত ছাপা হওয়ার আগ পর্যন্ত। আর কোথাকার কোন ছোকড়া এসে আমার লেখা পড়ছে। তাও আবার আমার অনুমতি না নিয়ে। এখনই এক ধমক লাগাতে হবে। মনে মনে ধমক দেবার জন্য তৈরি হলাম।
আমার লেখাটা ওর হাতে। তখনই আমার চোখ গেল ছেলেটার হাতের দিকে। কয়েক সেকেন্ড আটকে রইলো ওর হাতের আঙ্গুলের উপর। ধমক দেয়ার কথা ভুলে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটার হাতের সবগুলো আঙ্গুল কেমন অদ্ভুত। আঙ্গুলের ডগাগুলো পুরোপুরি গোল। মনে হয় কেউ যেন অতি যত্নে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোল করে কেটে নিয়েছে। নখ জাতীয় কোন বস্তু নেই সেখানে। এ আবার কেমন মানুষ! একটু ভয় ধরে গেল মনে। জোর করে ভয় তাড়িয়ে ভাবলাম এখনই ভালো ভাবে খোঁজ নিতে হবে। সুবিধে না বুঝলে বিদায় করতে হবে তাড়াতাড়ি। এ সময় ছেলেটি আমার দিকে মাথা তুলে তাকালো।
আমি আগের মতই শার্টে বোতাম অর্ধেক লাগানো অবস্থায় দাড়ানো। আমার চোখের দিকে চাইলো সে সরাসরি। ওর দৃষ্টিতে কি এক যাদুকরি শক্তি আছে জানি না। আমিও সব ভুলে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। ভুলে গেছি ছেলেটির পরিচয় জানার কথা।
‘তুমি সায়েন্স ফিকশন লেখ?’ জানতে চাইলো ছেলেটি।
‘হ্যাঁ’ বোধহীন ভাবে জবাব দিলাম আমি।
‘এটা কোন পত্রিকায় পাঠাবে?’
‘বাতায়ন।’
‘ই-মেইলে না পোস্টে?’
‘ই-মেইলে।’
এবার ছেলেটি তার পকেট থেকে একটি যন্ত্র বের করলো। ছোট সাইজের ক্যালকুলেটর বা ভিডিও গেমের মত দেখতে। একটি লাল সুইচে চাপ দিতেই মনিটর জীবন্ত হয়ে উঠলো। এবার পরপর কয়েকটি সুইচে চাপ দিয়ে কিছু একটা প্রোগ্রাম ওপেন করলো। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ছেলেটি তার যন্ত্রটা আমার লেখাটার প্রত্যেক পৃষ্ঠার উপর একবার করে ধরে একটা সুইচ চাপলো। কাজ শেষ করে আমার দিকে চেয়ে বললো, ‘ই-মেইল এড্রেস দাও।’
আমি টেবিল থেকে একটি ডাইরি খুলে বাতায়ন পত্রিকার ই-মেইল এড্রেস দিলাম। নিজেকে কেমন যেন বোধহীন মনে হলো। যেন ওই ছেলেটি যা বলবে তাই করবো। নিজের অস্তিত্ব কেমন শুন্য মনে হলো। আশ্চর্য হয়ে নাকি ভয়ে এমনটা হচ্ছে বুঝতে পারলাম না। হয়তোবা ছেলেটার মাঝে এমন কোন শক্তি আছে যা আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছে।
আমার কাছ থেকে ই-মেইল এড্রেস নিয়ে সে আবার কিছু কাজ করলো তার যন্ত্রে। কয়েক সেকেন্ড পর যন্ত্রটির মনিটরে একটি হলুদ আলো জ্বলে উঠে ইংরেজিতে লেখা উঠলো ‘ডান!’ আমার দিকে চেয়ে সুন্দর একটি হাসি দিলো ছেলেটি। বললো, ‘হয়ে গেছে।’
কি হয়ে গেছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আগের মতোই তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। এবার সে নিজেই আবার বললো, ‘তোমার লেখা পৌছে গেছে পত্রিকা অফিসে। তুমি ইচ্ছে হলে ফোন করে খোঁজ নিতে পার।’
এবার যেন বোধোদয় হলো আমার। মনে মনে ভাবলাম ‘বলছে কি পিচ্ছি? লেখা কখন কিভাবে গেল বাতায়ন অফিসে।’ কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না।
আমার চেহারা দেখে হয়তে মনের কথা আন্দাজ করলো সে। বললো, ‘কি বিশ্বাস হচ্ছে না! ফোন করে খোঁজ নাও যে তোমার লেখা পেয়েছে কিনা।’
একটু থেমে আবার বললো, ‘অবশ্য তোমাদের এখানে তো আবার মেইল বঙ্ ওপেন না করে কিছুই জানা যায় না।’
কতক্ষণ পর ছেলেটি উঠে দাড়ালো। হাতের যন্ত্রটা মাথার উপর তুলে সুইচে চাপ দিল। বিপ বিপ করে শব্দ হলো দু’বার। আমার দিকে চেয়ে বললো, ‘এবার যেতে হবে। চলি।’
হেঁটে দরজা পর্যন্ত গেল সে। এ সময় যেন হুশ ফিরলো আমার। যেন অচেনা কোন রাজ্য থেকে এই মাত্র এখানে এলাম। পিছন থেকে বললাম, ‘শোন!’
ঘুরে দাড়ালো সে। কিছু বললো না। আমিই আবার বললাম, ‘তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো?’
‘আমি নুডাস।’
শুনে চমকে উঠলাম আমি। দু’পা এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। বললাম, ‘কি নাম বললে তোমার!’
ভুল শুনেছি কি না বুঝতে পারলাম না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমি নুডাস। নুডাসিন গ্রহে বাসিন্দা। যাকে নিয়ে তুমি সায়েন্স ফিকশন লিখেছো।’
পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলাম আমি। দরদর করে ঘামতে লাগলাম। কিছু বলতে চাইলাম; কিন্তু মুখ খুলতে পরলাম না। বিস্ময়ে তালা লেগে গেছে মুখে।
সে আবার বললো, ‘কয়েক দিন আগে এসেছিলাম পৃথিবীতে, তোমাদের দেখতে। আজ চলে যাচ্ছি।’
একটু থেমে আবার বললো, ‘আমি চলে যাবার পর কেউ আমাকে খুঁজতে আসতে পারে। এসব কথা কিছুই বলার দরকার নেই। তাহলে তুমি ঝামেলায় পড়তে পারো।’
কথা শেষ করে সে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি কয়েক মূহুর্ত নিশ্চল দাড়িয়ে থেকে ধপ করে বসে পড়লাম বিছানায়। জগ-গ্লাস তুলে নিয়ে তিন গ্লাস পানি খেলাম একসাথে। এরপর শুয়ে পড়লাম বালিশে।
এভাবে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। আম্মুর ডাক শুনে উঠে বসলাম। আম্মু বললো, ‘কয়েকজন লোক এসেছে গাড়িতে করে। সাথে মনে হয় পুলিশের গাড়িও আছে। ড্রয়িং রুমে বসেছে। তোমাকে ডাকছে।’
আম্মুর মুখটা শুকনো লাগছে। হয়তো লোকজন, সাথে পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গেছে। আমি গেলাম ড্রয়িং রুমে। চারজন লোক বসে আছে সোফায়। বেশ-ভুষা দেখে মনে হয় উচ্চপদস্থ কোন লোক হবে। আমাকে দেখে বললো, ‘কিছুক্ষণ আগে তোমার কাছে অপরিচিত একটি ছেলে এসেছিল?
সেই রহস্যময় ছেলেটার কথা মনে পড়লো আমার। সেই সাথে তার শেষ কথাটা। নিজেকে নিজে সাবধান করে দিয়ে বললাম, ‘কই নাতো! আমার কাছে তো কেউ আসেনি?’
একজন বললো, ‘তোমার মা যে বললো।’
বুঝলাম তারা আগে আম্মুর কাছে খোঁজ নিয়েছে। আম্মুই হয়তো বলেছে ছেলেটার কথা। হাসি দিয়ে বললাম, ‘এসেছিল; কিন্তু ও তো অপরিচিত কেউ না। আমার বন্ধু আবির।’ মিথ্যা কথাই বললাম।
সোফায় বসা চারজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। মুখে হতাশা নেমে এলো তাদের। একজন বিড়বিড় করে বললো, ‘হিসাব অনুযায়ী তো সবই ঠিক ছিলো।’
উঠে চলে গেল তারা। আমি আমার ঘরে এলাম। এ সময় মোবাইল বেজে উঠলো। বাতায়ন সম্পাদকের ফোন। সালাম দিয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে বললো, ‘তমাল, তোমার লেখাটা পেয়েছি। বেশ ভালো হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।’ ■