নীল তিমি বা সিনিয় কিত বা ব্লু হোয়েল । একটি অনলাইন প্রতিযোগিতামূলক খেলার নাম, এটি “নীল তিমি প্রতিযোগিতা (ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ)” নামেও পরিচিত। নীল তিমি বা ব্লু হোয়েল একবিংশ শতকের অনলাইন গেমগুলির মধ্যে একটি হিসাবে দাবীকৃত। নাম থেকে ধারণা করা ব্লু হোয়েল একটি রুশ অনলাইন প্রতিযোগিতামূলক খেলা। সোশ্যাল গেমিং পাতার প্রশাসকের নির্দেশ মোতাবেক ৫০ (পঞ্চাশ) দিন ধরে বিভিন্ন কাজ করতে হয় এবং সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে অংশগ্রহণকারীকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত ব্লু হোয়েল খেলতে গিয়ে ১৩০ জনেরও বেশি কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করা হয়।
নামকরণ
নীল তিমি নিজেই জীবনের একটি পর্যায়ে চলে আসে সমুদ্র তীরে, শুকনা ভূমিতে ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বাস্তব প্রমান পাওয়া যায় ২০০৮ সালে ৫৫টি নীল তিমি একযোগে সমুদ্র সৈকতে চলে আসে, উদ্ধারকারীরা তাদেরকে সাগরে ফেরত পাঠালেও তারা তীরের দিকে বারবার চলে আসে। আপাতভাবে মনে হয় আত্মহত্যাই যেন তাদের উদ্দেশ্য। ধাপে ধাপে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া এই গেমটির নাম তাই ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ বেছে নেওয়া হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।
ইতিহাস
এই খেলাটির মূল নাম সিনিয় কিত। সিনিয় কিত গেমটি রাশিয়ায় ২০১৩ সালে শুরু হয়, ফিলিপ বুদেইকিন নামে মনোবিজ্ঞানের এক প্রাক্তন ছাত্র নিজেকে ওই গেমের আবিষ্কর্তা বলে দাবি করে। একুশ বছরের ওই রুশ যুবকের দাবি, যারা মানসিক অবসাদে ভোগে, প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার কথা ভাবে, তাঁদের আত্মহত্যার জন্য মজাদার পথ তৈরি করাই এই গেমের ভাবনা।
ব্লু হোয়েল গেমটি ২০১৬ সালের মে মাসে রুশ পত্রিকা ন্যভায়া গ্যাজেটা মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসে সেখানে ভিকোন্তাকে নামের সামাজিক মাধ্যমের এফ৫৭ (এফ৫৭ মূলত ডেথ গ্রুপ নামে পরিচিত নামের একটি গোষ্ঠীর অনুসারী কমপক্ষে ১৬ জন কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যাকে এই গেমটির সাথে সম্পৃক্ততা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি রাশিয়ার উপর একটি নৈতিক ভীতির ঝড় তোলে , অসংখ্য প্রতিবেদন তৈরি হয় কিন্তু এখনও এর কোনটিই সরাসরি আত্মহত্যার সাথে নিদৃষ্ট গোষ্ঠীর কার্যক্রমকে কে দায়ী করার মতো যথেষ্ট মজবুত নয়।
এই গেমের সবচেয়ে আলোচিত দুই ভিকটিম হলেন, ইউলিয়া কোন্সটান্টিনোভা (১৫) ও ভেরোনিকা ভলকোভা (১৬)। তারা দুই জন একই সঙ্গে আত্মহত্যা করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাশিয়া ছাড়াও আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চীন, পাকিস্তান, ইতালিস সহ আরও ১৪টি দেশে বিভিন্ন নামে এই গেমটি চলছে।
কাঠামো
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, প্রশাসকগন অংশগ্রহণকারীদের ৫০ (পঞ্চাশ) দিনের জন্য পঞ্চাশটি ঝুঁকিপূর্ণ টাস্ক বা কাজ দিয়ে থাকেন। অংশগ্রহণকারীরা সেই সব নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রমাণস্বরূপ ছবি বা ভিডিও পাঠান বা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়ায় সেগুলি প্রকাশ করেন। সর্বশেষ, পঞ্চাশতম চ্যালেঞ্জটি হলো আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা করতে পারলেই খেলোয়াড় বিজয়ী। খেলাটির অন্যতম বিশেষ দিক, একবার খেলায় অংশগ্রহণ করলে খেলাটি কোনোভাবেই বন্ধ (আনইন্সটল) করা যাবে না। এমনকি কেউ বন্ধ করলে তাকে অনবরত নিজের এবং তার পরিবারের মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়। অ্যাডমিনদের সাথে অংশগ্রহণকারীদের যোগাযোগ করার উপায় সম্পর্কে কাউকে বলা নিষেধ। নির্ধারিত কাজটি শেষ করার সমস্ত প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মুছে ফেলার নির্দেশনা থাকে। শুরুর দিকের কাজগুলো বেশ সহজ এবং অন্যান্য গেমের চেয়ে আলাদা হওয়ায় অংশগ্রহণকারীরা মজা পেয়ে যায়। ২০১৫ সালে গেমটির জের ধরে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং প্রতিদিন ইন্সটাগ্রামে ব্লু হোয়েল গেমটিতে কে কোন লেভেলে আছে তা পোস্ট করার রীতিমতো একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
ধারাবাহিকভাবে, প্রথমে সাদা কাগজে তিমি মাছের ছবি এঁকে শুরু হয় খেলা, ভোর চারটে কুড়ি মিনিটে ঘুম থেকে উঠতে হয়, অংশগ্রহণকারীকে নিজেরই হাতে পিন বা ধারালো কিছু ফুটিয়ে নিজের রক্ত দিয়ে আঁকতে হয় আগেই কাগজে আঁকা তিমির ছবিটা, একা একা ভূতের চলচ্চিত্র দেখতে হয়, চ্যালেঞ্জের মধ্যে অতিরিক্ত মাদকসেবনও রয়েছে প্রতিদিন একেকটি দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং প্রতিটি দিনের মধ্যেই শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে।
গ্রেফতার
২০১৬ সালে ফিলিপ বুদেইকিন নামে মনোবিজ্ঞানের এক প্রাক্তন ছাত্র (যাকে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল) ব্লু হোয়েল গেমের আবিস্কারক হিসাবে গ্রেপ্তারকৃত হয়। সে দাবী করে, তার উদ্দেশ্য মূল্যহীন মানুষদের আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে সমাজকে পরিচ্ছন্ন করা। বুদেইকিন নির্দোষ এবং এটাকে নিছক মজা দাবী করলেও ২০১৬ এর মে মাসে সে নুন্যতম ১৬ জন কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার উস্কানিদাতা হিসাবে গ্রেপ্তারকৃত হয় এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ পরবর্তীতে সে দুইজন নাবালক আত্মহত্যার উস্কানির জন্যে দোষী প্রমানিত হয়।
তালিকাভুক্ত ঘটনাবলী :
এই গেম খেলতে গিয়ে সারা পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই প্রায় দেড়শোজন প্রাণ হারিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কিশোর।
ব্লু-হোয়েল নিয়ে সার্চে শীর্ষে ভারত
অনলাইন সুইসাইড গেম ব্লু হোয়েল। গত একবছরে ইন্টারনেটে ব্লু-হোয়েল বিষয়ক সার্চ সবচেয়ে বেশি হয়েছে এই ভারতের কলকাতায়। নানা শব্দের উল্লেখে বারবার খোঁজা হয়েছে অনলাইন গেমটির হদিস। তালিকার প্রথম দশে রয়েছে ভারতের আরও চারটি বড় শহর। এগুলো হলো-গুয়াহাটি, চেন্নাই, মুম্বাই এবং বেঙ্গালুরু।
গুগল ট্রেন্ডের বিস্ফোরক তথ্যে প্রশ্ন উঠছে, এই গেম নিয়ে  কেন এত উৎসাহ? শুধুমাত্র জানার ইচ্ছা থেকেই কি তথ্য তালাশ গুগলে? নাকি কোথাও অবসাদগ্রস্ত হয়েই খোঁজ মারণ খেলার? প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিশেষজ্ঞরা। সিটি অব জয়ে, নীল তিমির দাপাদাপিতে চিন্তায় অভিভাবকরাও।
নীল তিমির থাবায় আতঙ্কে গোটা ভারত। সম্প্রতি ব্লু হোয়েল গেমের ফাঁদে পা দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এক কিশোরও।
ক্রমেই গোটা দেশে নীল তিমির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। আর তাই এই গেমকে বন্ধ করতে কড়া পদক্ষেপ নিল মোদি সরকার। গুগল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, মাইক্রোসফট এবং ইয়াহুর মতো জনপ্রিয় সোশাল সাইটগুলি থেকে ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ গেমটির লিঙ্ক মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। যত শিগগিরই সম্ভব এ কাজ করতে বলেছে প্রশাসন।  
পাকিস্তান
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায়ে (কেপিকে) প্রথমবারের মতো দুইজন ব্লু হোয়েলের শিকার হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়।
বাংলাদেশ
অক্টোবর ২০১৭, ঢাকাস্থ একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ব্লু হোয়েল গেম খেলে আত্মহত্যা করে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পুলিশ বলছে সে আত্মহত্যা করেছে; তবে ব্লু হোয়েল গেম খেলে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এই ঘটনার পর বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷ এমতাবস্থায় বিটিআরসি, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং প্রাপ্ত লিংক বা ইউআরএলগুলোর ব্যাপারে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবার কথা বলেছে।
আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনার সান জুয়ান প্রদেশে মে ২০১৭ এ, ব্লু হোয়েল এ অংশগ্রহণ করে ১৪ বছরের এক কিশোর ইন্সেন্টিভ কেয়ারে ভর্তি হবার দাবী উঠে।
ব্রাজিল
কিশোরদের ব্লু হোয়েল এ সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে নিজের ক্ষতি এবং আত্মহত্যার বেশ কিছু প্রতিবেদন ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে। সরাসরি কোন নিশ্চয়তা না থাকলেও পুলিশের বেশকিছু তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই খেলার সাথে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে সর্বমোট আটটি আত্মহনন ও স্ব-অঙ্গহানির ঘটনা ব্রাজিল থেকে তালিকাভুক্ত হয়েছে |
চীন
মে ২০০১৭, জেজিয়াং এর নিংবোতে ১০ বছর বয়সী কিশোরীর মাধ্যমে একটি আত্মহত্যাকারী গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায়; যেখানে সে ব্লু হোয়েলের সাথে সংশ্লিষ্ট তার স্বেচ্ছায় অঙ্গহানির বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে।  তখন থেকেই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ খেলাটিকে বিভিন্ন ফোরাম ও সরাসরি প্রচার সক্ষম মাধ্যমকে নজরদারীতে রেখেছে।
পোল্যান্ড
সেপ্টেম্বর ২০১৭, ব্লু হোয়েলের প্রভাব পাইরজুসের (Pyrzyce) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন ছাত্রের স্বীয় ক্ষতির প্রতিবেদন তালিকাবদ্ধ হয়।
পর্তুগাল
এপ্রিল ২০১৭, অ্যালবুফেরায় (Albufeira) ১৫ বছরের একজন কিশোর ও ১৮ বছর কিশোরী পর্তুগালে ১ম ব্লু হোয়েলের শিকার বলে দাবী করা হয়। কিশোর ছেলেটির হাতে তিমি মাছের ছবি ধারাল কিছু দিয়ে আঁকান অবস্থায় হসপিটালে পাওয়া যায় এবং মেয়েটি ওভারপাস থেকে রেললাইনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পুলিশ, বাবা-মা এবং বন্ধুরা দাবী করে মেয়েটি ইন্টারনেটের “ব্লু হোয়েল” দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।পর্তুগালের মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারের সময় মেয়েটি জানায়, সে খুব একাকীত্বের মাঝে ছিল এবং স্নেহের অভাব অনুভব করত।
প্রতিক্রিয়া
মার্চ ২০১৭, রোমানিয়ান অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী কারমেন ড্যান এই গেমের বিষয়ে তার গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বুখারেস্ট এর মেয়র গাব্রিয়েলা ফায়ারা গেমটিকে “অত্যন্ত বিপজ্জনক” হিসাবে বর্ননা করেছেন।
ব্রাজিলে, ব্লু হোয়েলের বিপরীতে সাও পাওলোতে ব্যলিয়া রোজা (পর্তুগিজ: Baleia Rosa বা পিঙ্ক হোয়েল) নামে একটি সক্রিয় গোষ্ঠী শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে এগিয়ে আসে। তাদের মূলমন্ত্রই ছিল ইতিবাচক কাজ, জীবনের মূল্যবোধ তুলে ধরা এবং বিষণ্নতার সাথে যুদ্ধ।
অগাস্ট ২০১৭, ভারত সরকারের ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক মাধ্যমগুলিকে (গুগল, ইয়াহু, ফেসবুকসহ আরও বিভিন্ন) আনুষ্ঠানিকভাবে এই গেমটির এবং অংশগ্রহণকারীর মাঝের সকল ধরনের সংযুক্তি বিচ্ছিন্ন করার অনুরোধ জানায়।
তথ্য সংগ্রহ; উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ এবং  বিভিন্ন পত্রিকা থেকে

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *