টনি মরিসন। মার্কিন ঔপন্যাসিক, সম্পাদক এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার থেকে শুরু করে আরও অর্জন করেছেন ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেল, প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলসলি কলেজের সমাবর্তন ভাষণে তিনি বলেন-
আজ তোমরা সাফল্যের সঙ্গে এক মহৎ, সম্মানজনক ও তাৎপর্যময় ডিগ্রি অর্জন করলে, তাই শুরুতেই তোমাদের ধন্যবাদ। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পৃথিবীর অনেক অবদান, অগণিত অর্জন শেষাবধি সম্ভব হয়নি শুধু এগিয়ে না যাওয়ার কারণে।
তোমরা এখন মুক্ত, পরীক্ষার চাপ থেকে মুক্ত। তোমাদের সামনে এখন অবারিত জীবনের নতুন যাত্রাপথ। শিক্ষাজীবনের যত ঋণ, যত দায়Ñ সেসব শোধার সময় এখন। যাত্রা শুরুর পর আগের গৎবাধা সব পথ-ম্যাপ ছুড়ে ফেলতে পার। পথচলার পরিকল্পনা নতুন করে তোমার নিজেকেই বানাতে হবে। পৃথিবীকে দেখার ভঙ্গিটা হওয়া চাই অভিনব ও চিরসতেজ। অবাঞ্ছিত বিষয় বর্জন করে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ কর।
পথচলার সময় অবশ্যই মনে রাখবে, তুমি কোথা থেকে এসেছ। যে জায়গায় আমাদের জন্ম, সেখানকার ধুলাবালি আর স্বপ্ন সবাই আমরা লালন করি। পুরো পথেই নিজেকে প্রশ্ন করবেÑ ‘আমি কেন এই পথে?’ এর একটা উত্তর আমি তোমাদের বলতে পারি। সেটা হলো, জিততে। তুমি জিততেই এ পথে নেমেছ। এ জেতাটা হচ্ছে নিজের সম্ভাবনাময় শক্তির জয়। এ জেতাটা হলো শ্রেষ্ঠ হিসাবরক্ষক, প্রকৌশলী, শিক্ষক কিংবা তুমি যা হতে চাও, তা হওয়ার। যে সম্ভাবনা তোমার মধ্যে আছে, সেটার জন্য নিজেকে বিশ্বাস কর। অন্য কারও সাফল্য দেখে নিজের সফলতাকে বিচার কর না। অন্য কারও সফলতার গল্প পড়ার দরকার নেই, তুমি নিজেই নিজের গল্প হও।
কোন বিষয়ে তার আগ্রহ বেশিÑ এটা অনেক মানুষই পরে জানতে পারে। আবার কেউ কেউ আছে, যারা এটা কখনোই জানতে পারে না। এরই মধ্যে তুমি যদি তোমার লক্ষ্যটাকে স্থির করে থাক অথবা খুঁজছ এমন হয়, তাহলে মনে রেখ, কৌতূহলই এনে দেবে তোমার জীবনের সফলতা। অন্যদিকে স্বপ্ন সত্যি করতে হলে তোমার ভেতরে যে ‘তুমি’ আছে, তার কথা শুনতে হবে। আকাক্সক্ষা যদি বড় হয়, তোমার স্বপ্ন সত্যি হবেই। সততা, নৈতিকতা ও আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি তোমার স্বপ্নের সঙ্গে আপস না কর, তুমি সফল হবেই।
পথ বেছে নিতে তুমি যেমন স্বাধীন, সফল হওয়াটাও তোমার জন্য উন্মুক্ত। দরকার শুধু কঠোর পরিশ্রম এবং একটি স্বপ্ন। আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করলে, তাদের অনেকেই জানে না, তোমরা পৃথিবীটাই বদলে দিতে যাচ্ছ। আমি জানি, সত্যিই তোমরা পৃথিবীটা বদলে দেবে। কীভাবে বদলাবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাদেরই।
আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ আদর্শের জন্য সংগ্রাম করি। জীবনে সংগ্রাম করাটাই তো চিরসত্য। দরিদ্র দেশের ছোট্ট কোনো গাঁয়ে নাকি উন্নত দেশের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে একটি শিশু জন্ম নিল, সেটি মুখ্য বিষয় নয়। আমরা বিশ্বাস করি, সব মানুষের আত্মমর্যাদা ও মৌলিক সাম্যতায়। আরও বিশ্বাস করি, সব মানুষ শান্তি চায়। আমরা অসাধারণ সুন্দর এক পৃথিবীর বাসিন্দা। যদিও তা বিভক্ত বিভিন্ন দলে, তবু আমরা এক মানব সম্প্রদায়ের অংশ। সমতার পৃথিবী গড়তে তোমাদের সহযোগিতা দরকার। তোমরা যে যেখানেই যাও, ভবিষ্যতে যে যা-ই কর না কেন, তোমরা সেই পৃথিবীতে যোগ দিতে যাচ্ছ, উত্তরোত্তর যার বিশ্বায়ন ঘটছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেখানে তোমরা সবাই এক হয়ে কাজ করবে।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন আমার একটা অভ্যাস ছিল এমন যে, আমি হঠাৎ করে অধ্যাপকদের রুমে হানা দিয়ে প্রশ্ন করতামÑ জীবনের অর্থ কী? অধ্যাপকরা ঘাবড়ে যেতেন, ভাবতেন আমার ‘নিওরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার’ হয়েছে। সবাই যে এমনটা ভাবতেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতেন। কেউ বলতেন, ‘সুখ’ আবার কেউবা বলতেন, ‘জ্ঞান’। আমার কাছে জীবনের অর্থ হলো, আমার কাছের মানুষকে সুখী করার জন্য কাজ করা। তোমাদের কাছেও জীবনের আলাদা আলাদা অর্থ থাকতে পারে আর যদি না থাকে, তাহলে এ পথে ট্রাই করে দেখতে পার। অন্যের জন্য কিছু করার মধ্য দিয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে নাও। তাহলে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।