আবুল আলম : :
তারিখটা মনে নাই; তবে সনটা ছিল ১৯৩৭ – খুব সম্ভব ভাদ্র-আশ্বিন মাস। আমি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র – আমাদের যোগীরকান্দা গ্রামের প্রাইমারী মক্তবে পড়ি।
সে বারেই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, প্রথম বারের মত খুব ঘনিষ্টভাবে শের-ই-বাংলা (তখনও উনি ‘শের-ই-বাংলা’ হননি!)আবুল কাসেম ফজলুল হকে সাহেবের একান্ত সান্নিধ্যে আসতে। ঘটনাটি ক্ষুদ্র হলেও, আমার কাছে জীবনের অবিস্মরণীয় একটী মাইল ফলক! প্রায় আশী বছর আগের ঘটনা হলেও, আমার কাছে মনে হয় যেন এই তো মাত্র সেদিনের!
শের-ই-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেব (বরিশালে সবার ‘হক সাইব’) সবে মাত্র সাবেক অবিভক্ত বাংলার মুখ্য মন্ত্রী হয়েছেন। এবং তার অল্প পরেই ওনার নিজের গ্রাম, (বরিশালের) চাখার আসেন।কলকাতা থেকে ট্রেণে খুলনা এবং সেখান থেকে ওনাকে নিয়ে আসে একটি বড় লঞ্চ।ওনার গ্রাম চাখারে যাবার ছোট খাল লঞ্চ চলার অনুপোযোগী বিধায়, লঞ্চ নোঙ্গর করে বানারীপারার চাউলাকাটি গ্রামে ‘চাখার খালের’ মুখে – সুপরিচিত মিয়া বাড়ীর (সে কালের বন্দে আলী মিয়ার বাড়ী) সামনে। ওখান থেকে চাখার যাবার ব্যবস্থা নৌকায়।
হক সাইবের গ্রামের বাড়ীতে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে, চতুর্দিক থেকে বিভিন্ন আকার-প্রকারের ডজনে ডজনে নৌকা এসে লঞ্চের চার দিকে ভীড় করেছে – হক সাইব রে এক নজর দেখার জন্য।আমাদের মক্তব-মাদ্রাসা থেকে খুবই কাছেই লঞ্চ। আমা্র দারুণ ঈচ্ছা হোল ওনাকে এক নজর দেখার।কিন্তু আমি ছিলাম অনেক ছোট – মাত্র ৭ বছর বয়স আমার!কী করি, কী করি? তো, শেষ তক হাত-পা ধরে আমার দুই চাচাতো ভাই কে রাজী করালাম!ওরা আমার চেয়ে বড় হলেও, তেমন বড় না!যাই হোক, একটি ছোট ‘ডোঙ্গা’য় আমরা তিনজন লঞ্চের কাছে পৌছে গেলাম!চার দিকে নৌকা আর নৌকা! আমাদের ছোট্ট ডোঙ্গা টি লঞ্চ থেকে বেশ দূরে।খেয়াল করলাম যে শ’তে শ’তে লোকের মধ্যে আমরাই ছিলাম সবচে’ কম বয়সী।
হঠাৎ দেখি লঞ্চের ডেকের উপর পায়চারী করছেন বিশাল-বপু স্বয়ং হক সাইব – পরণে একটা চেকের লুঙ্গী ও গায়ে হাতা ওয়ালা সাধারণ সাদা গেঞ্জী, যা বুকের বাঁ পাশে বেশ একটু ছেড়া!দূর থেকে তাঁকে দেখেই খুব খুশী আমরা!কিন্তু, ঘটনার শেষ হতে আরও অনেক বাকী!
একটু পরে ওনার নজর পরল আমাদের উপর। তো, শুনলাম, উনি ওনার একজন পুলিশকে বলছেন, ‘যাও, ঐ বাচ্চা তিনটিকে তুলে লঞ্চে নিয়ে আস।‘ শুনে যে মনের কী অবস্থা হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু না, পর মুহূর্তেই আমাদের উদ্যেশ্য বললেন, ‘এই পোলারা, তোমরা মোর লইগগা কিছু তিতইল(তেতুল) পাতা যোগাড় হইররা আনতে পারবা? আমার এট্টু সর্দি-কাশি অইছে, গরম তিতইল পাতার ঝোল খাইতে পারলে ভাল লাগতো!’ কে পায় আমাদের! আমরা ‘পারমু’ বলে, নৌকা নিয়া বন্দে আলী মিয়া সাহেবের বাড়ীতে গিয়ে (আগে কোনদিন যাইনি ও বাড়ীতে) খুঁজে তেতুল গাছের অনেক গুলো ডাল ভেঙ্গে তড়ি ঘড়ি লঞ্চের কাছে গেলাম।দু’জন পুলিশ এসে তেতুল পাতা সহ আমাদের তুলে নিলেন লঞ্চে।
চমকের পর চমক – উনি নিজে আমাদের নিয়ে গেলেন খোদ ওনার নিজের কেবিনে।অমন সুন্দর রুম জীবনে এই প্রথম দেখলাম!বসালেন চেয়ারে। তার পর আলাপ!বাড়ী কোথায়, বাবার নাম, কে কোন ক্লাসে পড়ি ইত্যাদি।উল্লেখ্য যে সাথের ওরা দু’জন বয়সে আমার বড় হলেও, পড়ত আমার চেয়ে নীচের ক্লাসে!হয়তো সে কারণেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুরআণ শরীফ পড়তে পার?’ সেকালে আমাদের বাড়িতে আমরা প্রথমেই কোরআণ শরীফ দিয়েই শুরু করতাম লেখা পড়া। তো, ‘পারি’ বলায়, পড়তে বল্লেন, পবিত্র কুরআণ। মনে আছে, ‘লাক্কাদ যা আকুম, রাসুলুম মেন আনফুছিকুম…।‘ আয়াতটি পড়েছিলাম।
খুব খুশী হলেন উনি!খেতে দিলেন সুস্বাদু চকোলেট; যা জীবনে এই প্রথম দেখলাম ও খেলাম! এর আগে লজেঞ্জ (বলতাম, ‘লেবেনচুষ) খেয়েছি; চকোলেট না। বিদায়ের আগে প্রত্যেক কে দিলেন এক একটি চকচকে রূপার টাকা!উল্লেখ্য, সে সময়ে আড়াই টাকায় এক মণ চাউল পাওয়া যেত!
হক সাইব আমাদের পুরষ্কার দিয়েছেন, আশপাশের গ্রামে, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল সে কথা। শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঐ তিন টাকা দিয়ে সম্মিলিত মক্তব-মদ্রাসার সকল ছাস্ত্র-শিক্ষককে রসগোল্লা খাওয়ানো হয়েছিল।চার আনা সের রসগোল্লা! তিন টাকায় বার সের, যোগ এক সের ফাঊ!!!
[২৬শে অক্টোবর এই মহান নেতার জন্ম দিন,পরম শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে]