এই সময় জীবন যাপন ডেস্ক: বাচ্চাদের ছোট-বড় নানা ভুলের জন্য অনেক সময়ই ধৈর্য্য হারিয়ে অভিভাবকরা তাদের ওপর হাত তোলেন। বাচ্চাদের ফের একই ভুল করা থেকে আটকানোর জন্য মারধর করলেও পরবর্তীকালে এটি বাচ্চাদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে থাক।
১. ভুল করার পর মা-বাবার মারের হাত থেকে বাঁচতে বাচ্চারা মিথ্যে কথা বলতে শুরু করে। ক্রমশই মিথ্যে কথা বলা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়।
২. অনেক সময় সন্তান কথা না শুনলে তাদের মেরেধরে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন অনেক অভিভাবক। অভিভাবকদের এই পন্থাকেই তারা সঠিক মনে করতে শুরু করে। স্বভাবতই নিজের বন্ধুদের সঙ্গে কথায় কথায় মারপিটে জড়িয়ে পড়ে তারা।
৩. অভিভাবকের স্বভাবের প্রতিফলন ঘটে সন্তানের মধ্যে। মা ও বাবাকে দেখেই বাচ্চারা অনেক কিছু শেখে। ছোট-খাটো বিষয় বাচ্চাদের বকাবকি বা মারধর করলে সেটাকেই তারা ভুল সংশোধনের সঠিক পদ্ধতি মনে করে। পরবর্তী কালে যে কারও ভুল শুধরানোর জন্য তারা এই পদ্ধতিই গ্রহণ করে।
৪. মারধরের কারণে যে শুধু শারীরিক পীড়া হয় তা-ই নয়, বরং মানসিক দিক দিয়েও তারা আঘাত প্রাপ্ত হয়। তাদের মনে ভয় বাসা বাঁধে। এর ফলে তারা সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে শুরু করে। আবার অধিক হিংসার শিকার বাচ্চাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এমনকি কঠিন পরিস্থিতি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, তাও বুঝে উঠতে পারে না তারা। এ ভাবেই ধীরে ধীরে অবসাদের কবলে পড়ে বাচ্চারা।
৫. কিছু কিছু অভিভাবক কথায় কথায় বাচ্চাদের দোষ-ত্রুটি বার করেন। তারা ভালো কিছু করার চেষ্টা করলেও, তার মধ্যে খুঁত ধরেন। অনেক অভিভাবকই নিজের বাচ্চার সঙ্গে তাদের বন্ধুর তুলনা করে থাকেন। এর ফলে নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাতে শুরু করে তারা। নিজেকে অন্যের তুলনায় দুর্বল ও গুড ফর নাথিং মনে করতে থাকে।
৬. সবসময় মারধর করলে তাদের আত্মবিশ্বাসও আহত হয়। নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ক্রমশই একাকীত্বে ভুগতে শুরু করে।
৭. অধিক মারধর করলে হীতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। মার খাওয়ার ভয় চলে গেলে, ভুল সংশোধনের পরিবর্তে তারা একই ভুল বার বার করতে থাকে।
৮. বাচ্চা সব সময় মার খেলে মা-বাবার প্রতি তাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ফলে তারা মা-বাবা থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। আবার বাচ্চাদের মনে রাগ জমলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য অভিভাবক বা অন্যদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। অনেক সময় রাগ পুষে রাখে এবং ভবিষ্যতে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে।
৯. মার খাওয়া গা-সওয়া হয়ে গেলে এক সময়ের পর বাচ্চারা ঢিট ও জেদি হয়ে পড়ে। কিশোর অবস্থায় পৌঁছতে পৌঁছতে তারা সম্পূর্ণ রূপে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন ভালোবেসে বা আদর করে কিছু বললেও মা-বাবার কথা কানে তুলবে না তারা।
১০. যে কোনও ভুলের জন্য শুধু মার খেলে, বাচ্চারা তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন মা-বাবার বকাবকি বা মারধরকে গায়ে মাখে না তারা।
মারধর না-করে বাচ্চাদের অনুশাসনে রাখার বিকল্প পথ
মনে রাখবেন, জন্মের সময় বাচ্চাদের মধ্যে দুর্ব্যবহারের প্রবণতা থাকে না। আশপাশ থেকে দেখে বা তারা যেমন ব্যবহার পায়, তার ভিত্তিতে নিজের স্বভাব ও আচরণ গড়ে তুলতে শুরু করে। বাচ্চা দুষ্টুমি বা ভুল করলে মারধর, চেঁচামেচি না-করে অন্য উপায় তাদের সংশোধনের চেষ্টা করুন।
এর জন্য সবার আগে নিজেরা শান্ত হন, ধৈর্য্য ধরুন। বাচ্চারা কোনও ভুল করলে নিজের রাগ তাদের ওপর বার করবেন না। যে মুহূর্তে বুঝতে পারবেন, বাচ্চার ওপর হাত উঠে যেতে পারে, এক পা পিছিয়ে আসুন, জল খান। নিজেকে সময় দিন, মাথা ঠান্ডা করুন। আপনি সে সময় নানা চাপের মধ্যে থাকতে পারেন, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সন্তানের ভুলের জন্য নিজের সমস্ত রাগ তাদের ওপর বার করে দেবেন। পরিবর্তে তাদের কথা শুনুন। হতেই পারে যে, আপনার অনুমতি না পাওয়ার আশঙ্কায় তারা কিছু না বুঝেই ভুল পদক্ষেপ করে ফেলেছে। চেঁচানো বা মারধরের আগে তাদের কথা শুনুন।
সন্তানকে নিজের বন্ধু বানান। মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক এমন হোক, যাতে সন্তান নির্দ্বিধায় নিজের মনের কথা মা-বাবাকে খুলে বলতে পারে। এর ফলে বাচ্চাদের মনে চলতে থাকা নানা বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকবেন। পাশাপাশি সন্তানের ভুল-ঠিক দুই চিন্তাভাবনার প্রতিও সচেতন থাকবেন। এর ফলে সন্তানের ভুল সংশোধনের সময় ও সুযোগ পাবেন। সন্তানের বয়স কম বা বেশি— যা-ই হোক না কেন আদতে পরিবারেরই লাভ হবে এতে।
অনেক সময় ভুল স্বীকার করে নেওয়ার পরও বাচ্চাদের কপালে মার জোটে। এই অভ্যাস এক্ষুনি ত্যাগ করুন। কারণ এর ফলে তারা সত্যি কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ভুল স্বীকার করে মার খাওয়ার পরিবর্তে মিথ্যে কথা বলে মারের হাত থেকে বাঁচতে চাইবে। তাই মারধরের পরিবর্তে ধৈর্য্য ধরে বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন। বাচ্চারা ভুল স্বীকার করলে, তাদের মারবেন না। ভুল শুধরে নিতে এবং ভবিষ্যতে একই ভুল না-করতে বলুন। ফলে তাদের মিথ্যে বলার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনই সত্যি কথা বলার অভ্যাস বজায় থাকবে।