শুভা জিনিয়া চৌধুরী
সে অনেককাল আগের কথা। তখন শিশুরা পড়ত ‘অ–তে অজগর ওই আসছে তেড়ে’। মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে বলতেন, ‘ওই দেখো চাঁদ মামা।’ মায়ের মুখে চাঁদ শুনতে শুনতে শিশুটিও আধো আধো বোলে বলে উঠত ‘চাঁ…দা মামা’।
সময়ের হিসাবে হয়তো খুব বেশি নয়। পাঁচ, ছয় বা সাত বছর। কিন্তু পরিবর্তনের বিচারে সময়টা যেন গিয়ে ঠেকেছে একাল আর সেকালে। একালে শিশুরা আর ‘অ’, ‘আ’ দিয়ে হাতেখড়ি করে না। শুরুটাই যে হয় ‘এ ফর অ্যাপল’ দিয়ে। মায়েরাও আর চাঁদ, সূর্য, ফুল খাননা। শেখাটা শুরু হয় মুন, সান, ফ্লাওয়ার দিয়ে।
এরপর একটু বড় হতেই শিশুটি ছোটে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। সেখানে সে ইংরেজি পড়ে। বাড়িতে ইংরেজি বলে। মা-বাবাও শিশুর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন। ঠিক কবে থেকে যেন আমাদের মগজে ঢুকে গেছে, যত বেশি ইংরেজি, তত বেশি উন্নতি। যত বেশি ইংরেজি, তত বেশি দৌড়ে এগিয়ে থাকা। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে পড়াতে গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। তাই মাস শেষে চাই মোটা টাকা। এই ছোটাছুটিতে পড়ে শিশুটির হয়তো মা-বাবাকেই ভালো করে চেনা হয় না। অথবা মা-বাবা হয়তো সন্তানকেই চিনতে পারেন না। জানেন না, ছোট্ট ছেলেটি বা মেয়েটির কী পছন্দ? বাংলা না ইংরেজি কোন গানের সুর তাকে টানে? নজরুলের ‘ভোর হলো দোর খোলো’ কবিতাটা কি সে পছন্দ করে, নাকি তার বেশি পছন্দ ‘জনি জনি, ইয়েস পাপা’।
কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে পড়ানোর কেন এত সাধ? আর সেই সাধ আর সাধ্য মেলাতে কেনই বা এত ছোটাছুটি? এমন প্রশ্ন করলে হয়তো থমকে যাবেন অনেকেই। সত্যি কি কারণটা জানেন তাঁরা?
মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মায়ের কাছে প্রশ্নটা করতেই তিনি কিছুটা থমকে গেলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, ‘চারপাশের সবাই তো পড়ান। আমরা না পড়ালে কেমন হয়!’
এটা ঠিক, বেশির ভাগই হয়তো জানেন না, ঠিক কেন তাঁরা সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত। বাংলা স্কুলে পড়ালে সন্তান ইংরেজি কম জানবে, এমন অকাট্য প্রমাণও কারও কাছে নেই। তাহলে তো আমাদের আগের প্রজন্মের কারও ভালো ইংরেজি জানারই কথা নয়। কিন্তু লেখা বা বলায় দেখুন, বাংলা স্কুলে পড়া অগ্রজদের দক্ষতা অনেক বেশি।
বিখ্যাত মানুষদের কজনই বা ইংরেজি স্কুলে পড়েছেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সত্যজিৎ রায়—কেউ কি ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছিলেন?
আবার ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেই যে ভালো ইংরেজি জানা যায়, তা–ও কিন্তু নয়। কাছের এক আত্মীয়ের মেয়ে রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। একই ক্লাসে বাংলা স্কুলে পড়ে আমার কন্যা। দুজনকে একদিন খেলার ছলে সারা দিন কী কী করেছে, লিখতে বললাম ইংরেজিতে। একটা বাংলা বাক্যের মধ্যে তিন–চারটি ইংরেজি শব্দ বলা আত্মীয়ের সেই মেয়েটি যা লিখল, তাতে আমার চোখ কপালে। বাক্য ও বানানে অনেক ভুল। ক্লাসে কী শেখায় জানতে চাইলে মেয়েটি মাথা নিচু করে রইল। জানাল, শিক্ষকেরা শুধু ক্লাস নোট দেন। তারা সেগুলো পড়ে পরীক্ষা দেয়।
অথচ এই মেয়েকে ইংরেজি স্কুলে পড়াতে গিয়ে কী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তার বাবা। ভাবতে বসলাম, এত টাকা দিয়ে পড়িয়ে কী লাভ হচ্ছে? মেয়েটি ইংরেজি ও বাংলা কোনো ভাষাই তো ভালো করে শিখতে পারেনি।
ভাষাবিদেরা বলেন, আসলে ভাষার দক্ষতা ইংরেজি বা বাংলা মাধ্যমের স্কুলের ওপর নির্ভর করে না। ইংরেজি স্কুলে পড়েও ভালো বাংলা জানা যায়। যদি পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই চর্চা থাকে। আর বাংলা স্কুলে পড়েও ভালো ইংরেজি শেখা যায়। পদ্ধতিটা সেই একই। পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চর্চা। মা-বাবা ও অভিভাবকের মূল লক্ষ্যটা হওয়া উচিত, সন্তান যেন শুদ্ধভাবে ইংরেজি ও বাংলাটা শিখতে পারে।
এক বন্ধুর মেয়ের কথা বলি। এই মেয়েও ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী। তবে মেয়েটি বাংলাও লেখে দারুণ। হুমায়ূন, জাফর ইকবাল, সুনীল, শীর্ষেন্দু থেকে শুরু করে তিন গোয়েন্দাসহ ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদ সব তার পড়া। পড়ে ইংরেজি বইও। দুটো মাধ্যমেই সে দক্ষ। মেয়েটির মা জানালেন, স্কুলে বাংলার ওপর গুরুত্ব কম দিলেও ছোট থেকেই মেয়ের হাতে বাংলা বই তুলে দিয়েছেন তিনি। আর বই পড়ার নেশা থেকেই তার বাংলা শেখা।
আজকাল একটা প্রবণতা খুব দেখা যায়। সন্তানকে সবাই দেশের বাইরে পাঠাতে চান। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়েই যেন সব সুখের ঠিকানা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর ঝোঁকটা হয়তো সেখান থেকেই। অভিভাবক হিসেবে সেটা দোষের নয়। কিন্তু বাংলা স্কুলে পড়লে দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যাবে না বা ভালো চাকরি করা যাবে না, এমন ভাবনার পেছনে যুক্তি কম।
আমার দেখা এক সহকর্মীর যুদ্ধের গল্পটা শুনুন তাহলে। অনেকেই হয়তো এত দিনে গল্পটা জেনে গেছেন। ইংরেজি তো দূরের কথা, বাংলা স্কুলেই পড়ার সংগতি ছিল না এন এইচ সাজ্জাদের। তবে রাজমিস্ত্রি বাবা আর গৃহকর্মী মায়ের স্বপ্নটা ছিল অনেক বড়। গ্রামের স্কুলে পড়েই মাধ্যমিকে জিপিএ ফাইভ পান সাজ্জাদ। চট্টগ্রাম কলেজে তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে ঘুরে আসেন সে দেশ। প্রথম আলোর ইংরেজি বিভাগে কাজ করতে করতেই যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে চলে গেছেন স্নাতকোত্তর করতে। সাজ্জাদ কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েননি।
সরকারি বা বেসরকারি সিংহভাগ চাকরির বিজ্ঞাপনেই শর্ত হিসেবে ইংরেজি মাধ্যম চাওয়া হয় না। তবে কেন এত দৌড়াদৌড়ি?
সেই কবে রবি ঠাকুর তাঁর সেজদার বলা কথা ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন’ মনে করিয়ে দিয়েছেন। তারপর কেটেছে শত বছর। কে–ই বা মনে রেখেছেন মাতৃভাষার গুরুত্বের বাণী? কিন্তু মনে রাখাটা খুব দরকার। এটাও মনে রাখা দরকার, ‘আমি ভাত খাই’ ঠিকঠাক বলতে বা লিখতে শেখাতে পারলেই সন্তান ‘আই ইট রাইস’ বলা বা লেখা শিখবে।
বাংলা বা ইংরেজি যে স্কুলেই সন্তান পড়ুক না কেন, তার ভাষাগত দক্ষতা বাড়াতে জোর দিতে হবে অভিভাবককে। সাধ আর সাধ্যের সঙ্গে মিল রেখে সন্তানকে নিজের ইচ্ছেমতো ডানা মেলতে দিতে হবে আকাশে। তবেই ছানাসন্তান একদিন পাখি হয়ে উড়তে আকাশে পারবে।