একটি দেশের বিমানবন্দর কেবল সাধারণ ফ্লাইট কিংবা যাতায়াতের মাধ্যমই নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে অগ্রগতির অন্যতম প্রতীক। যেখানে বিমানে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে, কয়েক দশক পরে সেখানে নগর উন্নয়নের পাশাপাশি আর্থসামাজিক সমৃদ্ধিও ঘটে। এ কারণেই বিমানবন্দরহীন দেশ খুঁজে পাওয়া বিরল। তবে বিশ্বজুড়ে এমন কয়েকটি দেশ রয়েছে, যেখানে বিমানবন্দর নেই।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছানোর নিরাপদ ও দ্রুততম মাধ্যম হলো উড়োজাহাজ। বর্তমানে মুহূর্তেই এই বিস্ময়কর যানে চেপে কয়েক মিনিট থেকে শুরু করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় দূর-দূরান্তের যে কোনো দেশে। এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আছে বিমানবন্দর। তবে আপনার এ ধারণা কিন্তু সঠিক নয়! এমনো কিছু দেশ রয়েছে যেসব দেশে সরাসরি যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এখনো বিশ্বের পাঁচটি দেশে নেই কোনো বিমানবন্দর। বিমানবন্দর ছাড়া এই দেশগুলোয় পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। তাই বলে ভাববেন না! এগুলো দরিদ্র রাষ্ট্র। পাঁচটি দেশ প্রতিটি পরাক্রমশালী। কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, ভৌগোলিক এবং বৈশ্বিক দুভাবেই। বিমানবন্দর না থাকার কারণও বিস্তর। ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তনে ছোট, বিমানবন্দর নির্মাণে ‘স্থান স্বল্পতা’, সমতল ভূমির অভাবসহ আরও বেশ কয়েকটি কারণে এসব দেশে নেই কোনো বিমানবন্দর। তবে দেশগুলোর ভাগ্য ভালো, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে তারা। তালিকায় থাকা পাঁচটি দেশই পার্শ¦বর্তী দেশের বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত, তাই নিজেদের দেশের বিমানবন্দর স্থাপনের থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিমানবন্দরে যাতায়াত করায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এটাই তাদের কাছে সহজ উপায়। আর হবেই না কেন? নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে একটি আধুনিক বিমানবন্দর স্থাপনে প্রয়োজন সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা। যার বেশির ভাগ নেই ভ্যাটিকেন সিটি, মোনাকো, সান মারিনো, লিচেনস্টাইন এবং অ্যান্ডোরার মতো দেশে। আর হ্যাঁ, বিমানবন্দর না থাকলেও এসব দেশ থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যাতায়াতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা। ফলে এসব দেশ তাদের পাশের রাষ্ট্রগুলোর বিমানবন্দর ব্যবহারকেই বেশি সহজ বলে মনে করে।
ভ্যাটিকান সিটি
ছোট্ট নগরী ভ্যাটিকান সিটি। তিবের নদীর কূল ঘেঁষে ভ্যাটিকান সিটি অবস্থিত। ভ্যাটিকান সিটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে স্বীকৃত। মাত্র ৪৯ হেক্টর আয়তনের এই ক্ষুদ্র দেশে জনসংখ্যা কমবেশি ৮২৫-এর মতো। ভ্যাটিকেন সিটিতে নেই কোনো নিজস্ব বিমানবন্দর। কারণ, ‘স্থান স্বল্পতা’। দেশটি এতটাই ছোট যে, সেন্ট পিটার স্কয়ার বাদে এখানে হালকা বিমান অবতরণ করতে পারে এমন স্থানও নেই। নেই সমুদ্রবন্দর, নদীপথ কিংবা অন্য কোনো ব্যবস্থা। ইতালির রোম শহরের মাঝখানের শহর ভ্যাটিকান। তাই বিমানবন্দরের বিকল্প হিসেবে রয়েছে মেট্রোরেল। শহরটিকে ঘিরে আছে ফিউমিসিনো রেলস্টেশন এবং সিয়াম্পিনো রেলস্টেশন। ৩০ মিনিটেরও কম দূরত্ব। এ ছাড়া পিসা, নেপলস এবং ফ্লোরেন্সের সঙ্গেও শহরের রেল যোগাযোগ রয়েছে। কাছাকাছি ইতালির রিমিনির ফেদেরিকো ফেলিনি বিমানবন্দরই স্থানীয়দের ভরসা। এটি মাত্র নয় মাইল দূরত্বে অবস্থিত। রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-ফিউমিসিনো বিমানবন্দর ভ্যাটিকান সিটি থেকে প্রায় ১৮.৫ মাইল দূরে। আর যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রয়েছে ভূগর্ভস্থ বাস বা ট্যাক্সি।
সান মারিনো
ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ সান মারিনো। আয়তন মাত্র ২৪ বর্গমাইল। আর জনসংখ্যা ১ কোটি কিংবা ৫০ লাখ তো দূরের বিষয়, ৫০ হাজারও নয়। খুব বেশি হলে ৩৪ হাজার হবে। শহরটি সম্পূর্ণরূপে ইতালি দ্বারা বেষ্টিত। রাজধানী রোম থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তবে ভ্যাটিকান সিটির ঠিক পেছনে অবস্থিত বিশ্বের প্রাচীনতম রাজ্য সান মারিনো। ছোট্ট দেশটির নেই কোনো নিজস্ব বিমানবন্দর। সান মারিনোর আয়তনের অর্ধাংশের বেশি জুড়ে আছে মাউন্ট টাইটানো (৪০ কিলোমিটার)। খুব বেশি উঁচু নয়, তবে এটি সান মারিনোর ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি পর্বতমালা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভাগ্য যে, এখানে সমতল ভূমির অভাব খুবই কম। আর এটি আধুনিক বিমানবন্দর স্থাপনে সবচেয়ে বড় বাধা। যদিও দেশটির নিকটতম বিমানবন্দরের মধ্যে অন্যতম রিমিনি এয়ারপোর্ট। যা ফেদেরিকো ফেলিনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত। মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সান মারিনো ছোট, কিন্তু এর যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো। এখানে প্রবেশে বোলোগনা, ফ্লোরেন্স, পিসা এবং ভেনিসের বিমানবন্দরগুলো ব্যবহার করা যায়। যা স্থানীয়দের জন্য তো বটেই, দেশটিতে আসা পর্যটকদের জন্যও একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা।
লিচেনস্টাইন
লিচেনস্টাইন, আরেকটি ছোট্ট রাজত্ব। জনসংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার। পশ্চিম-দক্ষিণে সুইজারল্যান্ড এবং পূব-উত্তরে অস্ট্রিয়া সীমান্তে অবস্থিত। আয়তন মাত্র ১৬০ বর্গকিলোমিটার (৬২ বর্গমাইল), যা ইউরোপের চতুর্থতম ছোট। আর ব্যাসার্ধে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার। খুব বেশি উঁচু নয়, তবে ছোট ছোট পাহাড়ে আবৃত রাষ্ট্র লিচেনস্টাইন। যদিও লিচেনস্টাইনের বেশির ভাগ ভূমি উঁচু-নিচু, তবে স্থানীয় স্কান শহরের উত্তরে একটি ছোট সমতল ভূমি রয়েছে, যা শুধু কৃষিভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে নেই কোনো নিজস্ব বিমানবন্দর। মূলত সমতল ভূমির অভাবে লিচেনস্টাইন সরকার কোনো বিমানবন্দর নির্মাণ করেনি। কখনো বিমানবন্দর নির্মাণ করতে চাইলে এর আংশিক পড়বে পূর্বের রাইন শহর (সুইজারল্যান্ডের অঞ্চল) এবং পশ্চিমের পর্বতমালা অর্থাৎ অস্ট্রিয়ায়। এসব কারণে লিচেনস্টাইনের জনসাধারণকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ফ্লাইটের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশটির রাজধানী থেকে মাত্র ২৪ মাইল দূরে অবস্থিত সুইজারল্যান্ড। স্থানীয়রা যাতায়াতের জন্য নিউজিল্যান্ডের জুরিখ বিমানবন্দর ব্যবহার করে থাকেন। তারা সেন্ট গ্যালেন-আলটেনরাইন বিমানবন্দর হয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেন।
অ্যান্ডোরা
দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র অ্যান্ডোরা। পূর্ব পিরিনীয় পর্বতমালায় ফ্রান্স ও স্পেনের মাঝামাঝি অবস্থিত দেশ। পাইরেনিস পর্বতমালা দেশটিকে ইউরোপের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশের মতো ছোট নয় অ্যান্ডোরা। জনসংখ্যাও মোনাকোর প্রায় দ্বিগুণ। আয়তনে প্রায় শতগুণ বড়; অর্থাৎ ৪৬৮ বর্গকিলোমিটার। ভৌগোলিকভাবে এটি গভীর গিরিখাত, সরু উপত্যকা ও সুউচ্চ পর্বতমালা নিয়ে গঠিত। এই দেশটিরও নেই নিজস্ব বিমানবন্দর। কারণ বিশালাকার পাহাড়। এখানে ৩ হাজার মিটারের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি উপত্যকা রয়েছে। যার প্রতিটি পর্বতমালায় আছে তিনটি রাস্তা। এ ধরনের উচ্চতায় আধুনিক বিমান চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক। বিশেষত যখন অ্যান্ডোরা ঘন কুয়াশা বা মেঘমালায় আবৃত থাকে। তাই স্থানীয়রা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিমানবন্দরের ওপর ভরসা করে থাকেন। কাতালোনিয়ায় এন-২৬০ রাস্তা থেকে ৩০ কিলোমিটার নিচে অ্যান্ডোরা-লা সেউ বিমানবন্দর। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৮০০ মিটার ওপরে অবস্থিত। এটি সম্পূর্ণ সমতল ভূমির ওপর নির্মিত। স্থানীয় ও দর্শনার্থীরা প্রতিবেশী লেরিদা, ট্যারাগোনা, বার্সেলোনা বা গিরোনার মতো শহরের ফ্লাইটে যাতায়াত করে থাকেন।
মোনাকো
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র মোনাকো। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ দেশ। আয়তন প্রায় ২.০২০ বর্গকিলোমিটার। দেশটির সীমানা মাত্র ৬ কিলোমিটার, যার দৈর্ঘ্যও মাত্র তিন কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩০৮-এর মতো। তিন দিকে ফ্রান্স অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর। ইতালির খুব কাছাকাছি দেশ মোনাকো। মোনাকোতে প্রায় ১২৫ দেশের মানুষের বসবাস। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- দেশটির নেই কোনো নিজস্ব বিমানবন্দর! আসলে দেশটিতে বিমানবন্দর স্থাপনের পর্যাপ্ত জায়গাও নেই। এমনকি ছোট বিমানবন্দর নির্মাণ করতে চাইলে দেশটির জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। সংকট সমাধানে দেশটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ফ্রান্সের নিস শহরের বিমানবন্দরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। যার নাম দে জিওর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মোনাকো থেকে নিসের মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্ব। আর হেলিকপ্টারে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্ব। নিস শহর এবং মোনাকোর মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আর হ্যাঁ, মোনাকোয় পৌঁছানোর জন্য গাড়ি কিংবা বাস ট্রিপই শেষ ভরসা। ফরাসি উপকূল থেকে মোনাকোয় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম মেট্রোরেল বা রেলপথ।
লেখক: