প্রিয় শিশু-কিশোর ভাই-বোনেরা! আজ তোমাদের বলব তোমাদেরই বয়সী এক শিশু ভাষা শহীদের কথা। তার নাম ছিল অহিউল্লাহ। তার বাসা ছিল নবাবপুরে। সে তোমাদের মতোই ভালোবাসত ছবি অাঁকতে, সময় পেলেই কাগজ, পেনসিল নিয়ে বসে পড়ত অাঁকাঅাঁকি করতে।
অহিউল্লাহর বাবার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রি। নিতান্তই গরিব মানুষ। তবুও দুই চোখজুড়ে ছিল স্বপ্ন, তার আশা ছেলেকে তিনি মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন। তাই তো তিনি ছেলেকে পড়তে পাঠালেন স্কুলে।
সময়টা ১৯৫২ সাল। অহিউল্লাহ স্কুলে যাওয়া-আসার পথে দেখত মানুষের মিছিল তারা বাংলা ভাষার দাবিতে সস্নোগান দিচ্ছে। আট বছর বয়সী অহিউল্লাহ বুঝতে পারে পাক শাসকগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে এ দেশের মানুষের ওপর চালাচ্ছে অত্যাচারের স্টিম রোলার। এমনকি কেড়ে নিতে চাচ্ছে তার প্রাণের ভাষা বাংলাকে। এর প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে ঢাকার অলিগলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এদিকে এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে। থমকে দাঁড়ায় পুরো শহর। চারদিকে থমথমে নীরবতা, মাঝে মাঝে গর্জন করে যাচ্ছে পুলিশের টহলধারী গাড়িগুলো। কেমন যেন বিপদের আভাস ফুটে উঠেছে প্রকৃতিজুড়ে।
একুশে ফেব্রুয়ারি। সকাল থেকেই ছাত্ররা জমায়েত হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। বাইরে অবস্থান নেয় হায়েনার দল। এর মধ্যেই ১৪৪ ধারা ভেদ করে ছাত্ররা মিছিল বের করে আকাশ কাঁপানো সস্নোগান ধরে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ভিত নড়ে ওঠে পাকিস্তানি শাসকদের। মুহূর্তেই গুলি এসে স্তব্ধ করে দেয় আওয়াজ, আর্তচিৎকার আর রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো নাম না জানা অনেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ।
২২ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পুরো শহরটা থমথমে। খুবই অল্প লোক রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করছে। গতকাল ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনেক মানুষ রক্ত দিয়েছে এ কথাটি জানত শিশু অহিউল্লাহও। এ জন্য সকাল থেকে তার মন খারাপ। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া হত্যাকা- ও বাঙালির প্রবল প্রতিবাদ দেখে ভয় পেয়ে সেনাবাহিনীকে ঢাকা শহরে মোতায়েন করা হয়েছিল। আর নবাবপুর রোডে দৈনিক সংবাদ অফিসের কাছেই ছিল মিলিটারির সবচেয়ে বড় ছাউনি। এ অদ্ভুত লোকদের দেখে খুব মজা পেয়েছিল নবাবপুরের খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানো অহিউল্লাহ। সে ভাবতে লাগল এদের কিভাবে ছবি অাঁকার বিষয়বস্তু করে তোলা যায়। মনটা তার এত খুশি হয়ে গেল যে, এক টুকরো কাগজ মুখে পুরে সমানে চিবুতে লাগল অহিউল্লাহ। যাদের দেখে সে অবাক ও বিস্মিত, তারাই শত্রু হয়ে গেল হঠাৎ। বলা নেই, কওয়া নেই একটা রাইফেলের গুলি এসে মাথায় লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অহিউল্লাহ। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ। এরপর সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এসে অহিউল্লাহর লাশ নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
অহিউল্লাহর বাবা-মা খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন হাসপাতালে। তারা হাসপাতালে থাকা পুলিশের কর্তাব্যক্তিকে বললেন, ‘আমাদের ছেলেটার লাশ দিন। আমরা তাকে দাফন করতে চাই।’ কিন্তু পুলিশ নানা বাহানা করে বিভিন্ন কথা বলে অহিউল্লাহর বাবা-মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল জোর করে। পুলিশ নিজেদের মতো করে অহিউল্লাহর লাশ দাফন করল, নাকি মাটিচাপা দিয়ে দিল, সে তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অহিউল্লাহর পকেটে পাওয়া গেল একটি রঙিন কাগজের টুকরো। সেখানে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু আর প্রজাপতির ছবি অাঁকা ছিল। খুব ভালোবেসে এ ছবিগুলো এঁকেছিল সে।
আমাদের ভাষার জন্য রক্ত দেয়া অহিউল্লাহর কোনো কবর নেই, তার কবর শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে তার কবর নেই। নানা জনের কাছ থেকে অহিউল্লাহর শারীরিক বিবরণের কথা শুনে শুনে ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের উদ্যোগে অাঁকা হয়েছে অহিউল্লাহর ছবি। ২০০৭ সালে ছবিটি অাঁকেন চিত্রকর শ্যামল বিশ্বাস। এ ছবিটি ভাষা শহীদ অহিউল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।