শরীফ আবদুল গোফরান :::
সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি লোক বাস করে। এই কোটি কোটি লোকের সকলে কিন্তু এক নয়। এদের কেউ দেখতে কালো, কেউ সাদা, কেউ তামাটে, কেউ লম্বা, আবার কেউ বেঁটে। এদের কেউ এশিয়ায়, কেউ আফ্রিকায়, কেউ ইউরোপে, কেউ আমেরিকায় আবার কেউবা অস্ট্রেলিয়ায় বাস করে।
এসব অঞ্চলের লোকদের ভাষা কিন্তু এক নয়, ভিন্ন। এরা কেউ বাংলায়, কেউ ইংরেজিতে, কেউ উর্দুতে, কেউ হিন্দিতে, কেউ আরবীতে কথা বলে। অর্থাৎ দুনিয়ায় যেমন রয়েছে নানান চেহারার, নানান বর্ণের মানুষ, তেমনি রয়েছে নানা ভাষা ও নানা দেশের মানুষ।
এই মানুষগুলো সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। অথচ তাদের মধ্যে রয়েছে একেক নিয়ম-কানুন। এদের পেশাও এক নয়। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ উকিল, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শিল্পপতি, কেউ শ্রমিক, কেউ শিক্ষক, কেউ চাকুরে, কেউ কিষাণ, আবার কেউ মজদুর। ফলে কেউ ধনী, কেউ গরিব, কেউ একেবারেই মিসকিন। সমাজে রয়েছে নানা গোত্রের নানা বংশের মানুষ।
এখন প্রশ্ন হলো, এই নানা দেশে, নানা বর্ণের, নানা ভাষার, নানা শ্রেণীর সকল মানুষ কি সমান মর্যাদার অধিকারী? এর জবাব একেক ধর্ম ও মতবাদ একেকভাবে দিয়েছে। কেউ বলে কালোদের চেয়ে সাদারা বড়। কেউ বলে আর্যরা অন্যদের চাইতে শ্রেষ্ঠ। কেউ মনে করে দুনিয়ার বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা স্রষ্টার নির্বাচিত জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ। আবার কেউ মনে করে সব ধর্মই হচ্ছে মানুষের জন্য আফিম। এভাবে একেক মতবাদ দুনিয়ার একেক বর্ণের গোত্রের, জাতির বা শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে অন্যদের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। এদের অনেকেরই ধর্মীয় উৎসব ও আচার-আচরণ এক নয়। বিভিন্ন গোত্র অনেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে তাদের নানান পর্ব পালন করে থাকে। এ ব্যাপারে ইসলামের মতামত যেমনি সরল, তেমনি সুস্পষ্ট। ইসলাম বলে দুনিয়ার সব মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি। ফলে তাদের গোত্র, বর্ণ, দেশ, ভাষা, পেশা, যাই হোক না কেন তারা সব সমান। তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ, উৎসব সবই সমান। এতে কোনো ভিন্নতা নেই।
মানুষ এসেছে হজরত আদম (আ.) থেকে। ফলে তারা সবাই ভাই ভাই। ইসলাম এক সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস করে। এজন্য সৃষ্টির সকল মানুষকে সমান মনে করে। ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এই শিক্ষা ইসলামের নানা বিধানের নানা পর্বের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ইসলামের এমনি ধারার এক মহান পর্ব হলো, “রমজানে ঈদ বা ঈদুল ফিতর।” আমাদের মুসলিম সমাজের এই উৎসব জাতীয় সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। ফলে আমরা ঈদ উৎসবকে মনের মতো সাজিয়ে বিভিন্নভাবে পালন করি, আমাদের কবি সাহিত্যিকরাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। আমাদের কবি সাহিত্যিকরা ছড়া, কবিতা ও গানে এ উৎসবকে জননন্দিত করে তোলেন। বাঙালি মুসলিম সমাজের ঈদ উৎসব যেমনিভাবে সকল মানুষের প্রাণে প্রাণে প্রবাহিত হয়, ঝংকৃত হয়, তেমনি সকল ছড়াকার ও কবির লেখায়ও মানুষকে জাগিয়ে তোলে, আনন্দিত করে।
ঈদ উৎসবকে নিয়ে লিখেননি এমন কবির সংখ্যা পাওয়া যাবে না। সকল কবি-ছড়াকারই ঈদ এলে ছড়া-কবিতা লিখে থাকেন। আমরা খুঁজলে দেখবো সকলেরই এক বা একাধিক ঈদের ছড়া-কবিতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করলে প্রথমেই আসে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তাঁর রচিত গান, কবিতায় মাতিয়ে তুলতেন ঈদ উৎসবকে। যেমনÑ নজরুলের লেখা একটি গানÑ
(ওমন) রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশির ঈদ/(তুই) আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্/আসমানি তাগিদ।
(তুই) পড়বি ঈদের নামাজরে মন/সেই সে ঈদগাহে/ যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম/হয়েছে শহীদ॥ (জুলফিকার)
এই ঈদ উৎসব থেকে বাদ পড়েননি কবি গোলাম মোস্তফাও। অনেক দরদ দিয়ে তিনি ঈদের কবিতা লিখেছেন। লিখেছেনÑ
“আজ নতুন ঈদের চাঁদ উঠেছে।” যেমনÑ
আজিকে আমাদের জাতীয় মিলনের/ পুণ্য দিবসের প্রভাতে/কেগো ঐ দ্বারে দ্বারে ডাকে/সবাকারে ফিরিছে বিশ্বের সভাতে। (ঈদ উৎসব/রক্তরাগ)
এ ক্ষেত্রে কবি ফররুখ আহমদের অবদান অনেক। তিনি লিখেছেন অগণিত ছড়া-কবিতা, তিনি ঈদ উৎসবকে বড়দের মতো করে যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ছোটদের জন্যও। তিনি তাঁর লেখায় নীল আকাশের নতুন চাঁদের সাথে মিতালি করতেন। ভাব জমাতেন। কথা বলতেন। জানাতেন খোশ আমদেদ, মুবারকবাদ। যেমনÑ
ঈদের বাঁকা চাঁদ উঠে ঐ/দূরে তরু শিরে/ঈদ মুবারক! ঈদ মুবারক!/আওয়াজ শুনি ফিরে।
নীল আকাশে ঝলমলিয়ে/ খুশির খবর যায় ছড়িয়ে/আনন্দেরি বান ডেকে যায়/শূন্য প্রাণের তীরে।
কবি বেনজির আহমদও আমাদের দেশের আরেকজন খ্যাতিমান কবি। তিনি ঈদের সকল দিক নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন ঈদের চাঁদ, ঈদ উৎসব, ত্যাগ, কোরবানী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। যেমনÑ
বরষ ভরা ভোগের শেষে/এলো ত্যাগের ঈদ,/জীবন দিয়ে জীবন লাভের/জাগলোরে উন্মিদ। (ত্যাগের ঈদ/হৈমন্তিকা)
কবি তালিম হোসেন ঈদ উৎসবকে গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে। তাঁর ঈদের পয়গাম, ঈদ মুবারক, ঈদের ফরিয়াদ, নতুন ঈদ, লেখায় ঈদুল ফিতর-এর খুশির আমেজ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমনÑ
সুন্দর সুখী মানবাত্মার/প্রশান্ত হাসি হেলালে ঈদ/আনিল আবার নয়া জামানায়/নতুন জিন্দেগীর তাকিদ। (ঈদের পয়গাম/দিশারী)
আমাদের দেশে ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর প্রকাশিত হয় নানা সংকলন। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করে বিশেষ সংখ্যা ও ক্রোড়পত্র। তখন দেশের সকল কবি ও ছড়াকার ছড়ায়-ছড়ায় ঈদের আনন্দকে নিয়ে যায় সকল মানুষের মনের গহীনে। এসব ছড়া ছোট-বড় সকল মানুষের মাঝে ঈদ উৎসবকে নিয়ে আসে নতুন সাজে। কবি আল মাহমুদ তাঁর লেখায় এনেছেন এভাবেÑ
আতর গন্ধি ঈদের খুশি/ঢুকলো এসে ঘরে/খোকন সোনা লাফিয়ে ওঠে/বালিশ কাঁধে করে।
হাসিটি তার রোজার শেষে/যেন ঈদের দিন/কোর্মা পোলাও পায়েশ খাবে/ধনী ও মিসকিন।
ঈদের খুশি বেহেস্ত থেকে/আনেন ফেরেস্তারা/সেই খুশিতে নীলের মাঝে/জাগল ধ্রুবতারা।
কবি আল মাহমুদের এই ছড়াটি পড়লেই বুঝা যায়, ছড়া ঈদের খুশিকে কোথায় নিয়ে গেছে। এ থেকে অনুমেয় যে, ছড়া এখন আর শৈশবের ছড়া নেই। ছড়া নেমে এসেছে রাজপথে। শাসক-শোষকের সমালোচনায়, কৃষক শ্রমিকের অগ্নিঝরা দাবি, স্বৈরাচার উৎখাতের হাতিয়ার, মজলুম জনতার নির্ভীক স্লোগান, নীল আকাশের ধ্রুবতারা আর ঈদের বাঁকা চাঁদে। ঈদের চাঁদ যেমনি মানুষকে চমকে দেয়, তেমনি ঈদের বাঁকা চাঁদকে নিয়ে লেখা ছড়া ও সবার মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে দেয়। সৌরভে ভরে যায় সবার মন। কবি সৈয়দ শামসুল হুদা তার ছড়ায় বলেন।
বাঁকা চাঁদের নাওটি দোলে/ নীল আকাশের অতল কোলে।
ঈদ হবে কাল ঈদ হবে/ভরে সকল হৃদয় খুশির সৌরভে।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শে সেখানে একটি সুখী সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। তখন মদীনায় ‘মিহিরজান’ ও ‘নওরাজ’ নামে দু’টি উৎসব পালিত হতো। মহানবী (সা.) ওই দুই পর্বকে বদলিয়ে দুই ঈদের প্রচলন করলেন। সেই হতে প্রতি বছর সারা দুনিয়ার মুসলমান রমজান মাসের শেষ দিন আকাশে চাঁদ দেখা গেলেই শাওয়াল মাসের পয়লা তারিখে ঈদুল ফিতরের উৎসব পালন করে থাকে। এ কারণে মুসলমানদের দুই ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি। এক মাস রোজা রাখার পর সবাই ভিড় জমায় চাঁদ দেখার জন্য। সূর্যাস্তের পর তাকিয়ে থাকে পশ্চিম আকাশের দিকে। চাঁদ দেখা মাত্রই ভঙ্গ করে রোজা রাখা। এ নিয়ে কবি শামসুল ইসলাম লিখেনÑ
রমজানেরই রোজার শেষে/ঈদের চাঁদে খুশির রেশ/খুশি তো নয় আনন্দ/বইছে বাতাস সুমন্দ/সটা ছেড়ে মন্দটা/ভঙ্ করে ছন্দটা।
মানুষ মরণশীল। চিরদিন কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। এক সময় আপনজনদের ছেড়ে চলে যেতে হয় পরজগতে। কিন্তু স্বজনরা তাদের হারানোর বেদনা ভুলতে পারে না। যাদের আব্বা-আম্মা নেই তারা প্রতি মুহূর্তে বেদনা অনুভব করে। কারণ আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দের তুলনা হয় না। কিন্তু আব্বা-আম্মা বেঁচে না থাকলে ঈদের খুশি অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়। বারবার তাদের কথা মনে পড়ে। ছড়াকার আবু সালেহ এসব স্মৃতিকে তার ছড়ায় এনেছেনÑ
বছর বছর ঈদ আসে/ওই আকাশে চাঁদ হাসে/হাসে খুকু হাসে খোকা/আমি কেবল হইযে বোকা।
বাবার সাথে ঈদ হয় না/ঈদের দিনে মা রয় না/আনন্দটা রয়না কোথাও মনে/তাদের ছবি ভাসে ক্ষণে ক্ষণে।
সত্তর দশকের প্রধান ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান ঈদের বাঁকা চাঁদকে ছড়ায় ছড়ায় ছোট্ট কোশা নায়ে তুলে দিলেন এভাবেÑ
চাঁদটা যেন ছোট্ট কোশা/ নীল সায়রে থমকে/চম্পা ফুলের পাপড়ি হয়ে/হঠাৎ ওঠে চমকে।
উধাও হাওয়া মেঘের পাখা/কার সাথে যে দুস্তি/অথই পানির বিশাল ঢেউয়ে/সাঁঝ সকালে কুস্তি।
অথচ এই ঈদের দিনেও কত মানুষ না খেয়ে থাকে। না খেয়ে থাকে অবুঝ শিশুরাও। কারণ বিশ্বজুড়ে আজ চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এই খেলা কত মানুষের ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে। ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া ছড়ায় ছড়ায় স্বজনহারা মানুষের ঈদ উৎসবকে এনেছেন এভাবেÑ
ঈদের খুশিতে এশিয়া মত্ত/আফ্রিকা-আমেরিকা/ফিলিস্তিনের শিশুরা জানে না/কী আছে তাদের ভাগ্যে লিখা!
স্বজন হারিয়ে আফগান কাঁদে/বোমায় ঝাঁঝরা হয়ে/সেই ঈদ কবে, পৃথিবীতে হবে/নতুন বারতা লয়ে?
একইভাবে ছড়াকার খালেক বিন জয়েন উদ্দীন তার ছড়ায়Ñ
ঘরে পিদিম বাইরে পিদিম/কই পিদিমের সলতে?
ঘরে বাইরে আঁধার দেখি/আর পারি না চলতে।
রান্না ঘরে শূন্যি হাড়ি/টিম টিমালো সলতে/এমনি দিনে ঈদযে এলো/দুখির ছোঁয়ায় জ্বলতে।
ঈদ এলে এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। উপহার হিসেবে পাঠায় ঈদ কার্ড, নতুন বই। এতে নতুন নতুন কথার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে দিয়ে সুন্দর অক্ষরে করে নিজের স্বাক্ষর। কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার ছড়ায় সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন এভাবেÑ
খুশির দিনে বন্ধুদেরকে/বই দিও/বইয়ের ওপর তোমার নিজের/
সই দিও।
সবাই মিলে পড়তে পারা/যায় বলে/সবচে ভালো এই উপহার/
ঝলমলে।
এই উপহার সবার চোখে/দেয় আলো/দূর করে দেয় সবার মনের/সবকালো।
ঈদুল ফিতর কথার মধ্যে দু’টি শব্দ আছে। ঈদ এবং ফিতর। ঈদ অর্থ উৎসব। যা বারবার ফিরে আসে। ফিতর কথার অর্থ হলো উপবাস ভাঙ্গা। সারা রমজান মাসে আমরা দিনের বেলায় পানাহার বন্ধ রেখে উপবাস করি, শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে ভঙ্গ করি বলে, এটা ফিতরের উৎসব বা ঈদুল ফিতর। ফিতরের এই অর্থের আরেকটা দিকও আছে। ফিতর শব্দ এসেছে ‘ফিতরাত’ থেকে যার অর্থ দাঁড়ায় প্রকৃতি। আর এই জন্যই ইসলামকে বলা হয় ফিতরাতের ধর্ম। অর্থাৎ ইসলাম প্রকৃতি বা স্বভাবসম্মত ধর্ম, সারা রমজান মাসে মুসলমানরা যে উপবাসের কষ্ট কবুল করে নেন, তা সমাজ জীবনে নিরন্ন ও উপবাসীদের উপবাসের কারণ দূর করতে চেষ্টা করে। এর মধ্যেই রমজান ও ঈদের সার্থকতা ফলে ঈদের চাঁদ দেখা, নতুন জামা কাপড় পরা, গরিবদের দান-খয়রাত করা সব কিছুতেই কল্যাণ রয়েছে। ফলে ঈদের চাঁদ দেখা থেকেই উৎসবের শুরু হয়। এতে বড়রা যেমন আনন্দ পায় তেমনি ছোটরাও। কবি জয়নুল আবেদীন আজাদ তার ছড়ায় ঈদের বাঁকা চাঁদের আনন্দকে এনেছেন এভাবেÑ
শাবান শেষে আসবে রোজা/রমজানেরই চাঁদে/দু’চোখ ভরে দেখতে সে চাঁদ/খোকা দাদুর কাঁধে।
পাতার ফাঁকে ইতি উতি/চাঁদযে মেঘের ফাঁদে/চাঁদের দেখা না পেয়ে সে/দাদুর কাঁধেই কাঁদে।
একই বিষয়কে কবি ছড়াকার আহমদ মতিউর রহমান এনেছেন এভাবে
ঈদ এলো আজ চৈতি হাওয়ায় ভেসে/দুপুর রোদের তপ্ত আভায়/
দিনটা অলস শুধুই ঝিমোয়/সূর্যি ডোবে চুমকুঁড়ি দেয় হেসে।
ইসলামের সকল শিক্ষার মতোই ঈদুল ফিতরেরও একটা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য আছে। ঈদের দিনে আমরা সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনা করি, তা যদি বৃহত্তর সমাজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে আমরা সক্ষম না হই, তবে আমাদের ঈদ উৎসব কিছুতেই পূর্ণ সার্থক হতে পারে না। ঈদের মাঠে যেমন আমরা বর্ণ, গোত্র, দেশ, ভাষা ও শ্রেণীগত পার্থক্য ভুলে গিয়ে একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরি, তেমনি বৃহত্তর সমাজ জীবনে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও আমাদের মহান দায়িত্ব। অথচ সারাবিশ্বের মানুষ ইচ্ছা থাকলেও সেভাবে ঈদের উৎসব পালন করতে পারছে না। পৃথিবীর বহু দেশ রয়েছে যেখানে ঈদ উৎসব হয়ে যায় কান্নার। স্বজন হারার বেদনাকে বুকে নিয়ে তারা ঈদ উৎসব পালন করে। কবি আহমদ আখতার তার ছড়ায় এসব তুলে ধরেনÑ
ঈদটা যদি সোমালিয়ায়/মানুষ অভুক্ত/ঈদটা যদি বসনিয়ায়/ তরতাজা রক্ত।
ঈদটা যদি ফিলিস্তিনে/ওজর আপত্তি/শতক শেষে স্বাধীনতা/ মিলবে কি সত্যি।
ঈদটা আসুক সবার ঘরে/আনন্দ হিল্লোল/বিশ্বজুড়ে খুশির ছোঁয়া/ জাগুক কলরোল।
ঈদ উৎসব পালনের জন্য অনেকে অন্ধকার পথ বেছে নেয়। অন্যায়ভাবে আয় করে অর্থ। জড়িয়ে পড়ে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিতে। কবি মনসুর জোয়ারদার তার ছড়ায় এসব লোকদের ঈদ উৎসব তুলে ধরেন এভাবেÑ
গভীর রাতে চলছে ছুটে/দূরপাল্লার গাড়ি/তন্দ্রা ঘোরে ঝিমায় বসে/শিশু, পুরুষ-নারী।
হঠাৎ করে থামিয়ে গাড়ি/দূরপাল্লার রাতে/গর্জে ওঠে ডাকাত দলে/দাও তুলে সব হাতে।
ঈদের মানে খুশি যে তাই/সবার জন্য আসে/হাইজ্যাকাররা ঈদের খরচ/পুষিয়ে নিয়ে হাসে।
রোজার মধ্যে প্রতিটি ভালো কাজে যেমন কল্যাণ নিহিত আছে, তেমনি রোজা শেষে ঈদ উৎসব পালন পর্যন্ত প্রতিটি কাজেও রয়েছে কল্যাণ। ফলে রোজা শেষ করে সবাই চাঁদ দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কোনো কারণে চাঁদ দেখা না গেলে সবাই টিভির সামনে বসে থাকে। কোথাও চাঁদ দেখা গেছে কি না সে খবরের জন্য। ছড়াকার ফারুক হোসেন তার ছড়ায় এভাবে বর্ণনা করেছেনÑ
হাল ছাড়ে না তবুও সবাই সূত্র ধরে অন্য/একটি চাঁদের আবির্ভাবে বার্তা শোনার জন্য/রাত্রি নামে ঘরের সবাই দেখল খবর টিভির/বলল টিভি চাঁদ দেখেছে লোকেরা পাঁচবিবির।
ঈদের চাঁদ দেখার পর যেন আর তর সয় না। বিশেষ করে বাড়ির ছোট্ট মনিদের মধ্যে এসব বেশি দেখা যায়। ঘুমাতে চায় না মোটেও। ভাবতে থাকে কখন ভোর হবে। কবি মোশাররফ হোসেন খান লিখেনÑ
ঈদ মানে তো খুশির খেলা/ফুলের মতো গন্ধে দোলা/ছন্দে ঝরা বৃষ্টি ধারা/টাপুর টুপুর/ঈদ মানে তো দোদুল দোলা/সকাল দুপুর।
একইভাবে কবি আসাদ বিন হাফিজ লিখেনÑ
পড়বো নামাজ জামাত করে/মিলবো গলায় গলা ধরে/ভুলে যাবো সব ভেদাভেদ দুঃখ-অভিমান/ঈদের খুশি ঈদের হাসি খোদার সেরা দান।
ঈদ এলে সবাই সবার খোঁজ-খবর নেয়। নেয় প্রতিবেশীদের খোঁজও। এতে সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের দায়িত্বও কম নয়। কবি গোলাম মোহাম্মদ লিখেনÑ
প্রজাপতি প্রজাদের খোঁজ কিছু নিও
ঈদ এলে হাতে হাতে ঈদ কার্ড দিও।
ঈদ উৎসব মানুষকে ভালোবাসা শিখায়। একে অপরকে কাছে টেনে নেয়া, বুকে জড়িয়ে ধরা শিখায়। শিখায় সব কষ্ট ভুলে গিয়ে শত্রুকেও বন্ধু বানাতে। সবাই যেন এক পরিবারের সদস্য। ঈদ এলে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরার মাধ্যমে মানুষকে নতুনের পথে পা বাড়ায়। কবি ফারুক নওয়াজ এ নিয়ে লিখেনÑ
ঈদের শিক্ষা কেন ভুলে যাই/ভুলতে চাই না আর/দুনিয়াটা হোক সত্য শুদ্ধ/মানুষের সংসার।
ঈদের দিন সবাই নতুন জামা কাপড় পরে ঈদগাহে যায়, আবার অনেক শিশুকে দেখা যায় পথের পাশে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। এদের নতুন জামা-কাপড় নেই। অনেকের ঘরে ভালো খাবারও নেই। তাদেরকে ভালো ভাবার দেবে। কে দেবে আদর সোহাগ। এসব নিয়ে কবি হাসান আলীম লিখেনÑ
নতুন জামা খশবু আতর/সোহাগ করে কে পরাবে/কোরমা পোলাও ফির্নি পায়েস/আদর করে কে খাওয়াবে।
ঈদুল ফিতর ইসলামের শ্রেষ্ঠ পর্ব বা একটি সামাজিক উৎসব। অন্য হিসেবে এটা একটা ইবাদত। কারণ ইসলাম একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ বলে এর উৎসবও ইবাদতে পরিণত হয়, যদি তা সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে পালিত হয়। কারণ এ উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। ঈদুল ফিতর উদযাপনের মধ্যদিয়ে মানুষের সকল দুঃখ ব্যথাও দূর হয়। কবি ইসমাইল হোসেন দিনাজী ঈদের খুশি কিভাবে পালন করবে তা ছড়ায় ছড়ায় বর্ণনা করেছেনÑ
দুশমনও হোক বন্ধু আজি/মিলাক বুকে বুক/সবার ছোঁয়ায় সবার দোয়ায়/ঘুচুক সকল দুখ।
ঈদুল ফিতর ঈদুল ফিতর/স্বপ্ন সুখের নদী/সব মানুষের দিলের ভেতর/বহুক নিরবধি।
ঈদ আসে আসে করে বাজারে ঝুলতে থাকে নতুন জামা-কাপড়। ভিড় জমে ক্রেতাদের। গরিব ছেলেরা উদোম গায়ে এসব জামা দেখে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তাদের তো নতুন পোশাক কেনার টাকা নেই। কবি চৌধুরী গোলাম মাওলা তার ছড়ায় ঈদ বাজারকে তুলে এনেছেনÑ
দোকানে ঝুলছে হরেক পোশাক
নামী-দামী মানুষের কত হাঁক ডাক।
জামা জুতো কিনছে ইচ্ছে যতো
যার যা ভালো লাগে মনের মতো।
বাহিরে দাঁড়িয়ে এক উদোম ছেলে
ঈদ আসে ঈদ যায় জামা না মেলে।
কবি আবদুল কুদ্দুস ফরিদী তার ছড়ায় বলেনÑ
হাসি খুশি উচ্ছলতায়/ঈদ হলো এক স্মৃতি/সবার মনে বিলিয়ে দেয়া/ভালোবাসা প্রীতি।
বড়রা যেমন ত্রিশ দিন রোজা রাখার পর ঈদ উৎসব পালন করে, তেমনি ছোটরাও এ কল্যাণ থেকে দূরে থাকে না। তারাও রোজা রাখে। রোজা রাখে সমাজের কুলি, মজুর সকলে। কবি জাকির আবু জাফর লিখেনÑ
আমরা সবাই রোজার দেশে ঈদ আনতে যাব/নতুন চাঁদের নোটিশ হলে ঈদকে খুঁজে পাব।
ঈদ খুশিতে দুলবে সবার প্রাণ
ঈদ আমাদের আনন্দ উদ্যান।
একইভাবে একই বিষয়কে নিয়ে কবি সাজজাদ বিপ্লব তার ছড়ায় রোজাদারদের কথা বলেছেনÑ
ছোটরা রোজাদার/রোজা রাখে রুলিও/মতিন আর জামসেদ/রোজা রাখে কুলিও।
সিজদায় রত দেখ/কিবা বড় ছোট সব/এতে খুশি সকলেই/করে সুখ অনুভব।
কবি ইকবাল কবির মোহন লিখেনÑ
ঈদ আসে ঘরে ঘরে/দোলা দেয় মন/চাঁদ হাসে মিটি মিটি/নেচে ওঠে বন।
আকাশের নীর ফুঁড়ে/হেসে ওঠে ঈদ/খোকা-খুকু দিশেহারা/চোখে নেই নিদ।
ঈদ এলে ছোট্ট শিশুরা বায়না ধরে নতুন জামা-কাপড় পাবার জন্য। বন্ধুরা একে অপরকে দাওয়াত করে। ছাড়াকার ওবায়দুল গনি চন্দনের ছড়ায়Ñ
হাজার খুশির খবর নিয়ে/ঈদ এসেছে আবার/সবার মনে একই খুশি/নতুন জামা পাবার।
ভাই-বোনেরা দাওয়াত রলো/আমার বাড়ি যাবার।
ঈদের দিন সবাই দান-খয়রাত করে সাধ্য মতো। এসব দান গ্রহণ করার জন্য গরিবরা ভিড় জমায় বাড়ি বাড়ি। কেউ আবার থালা-বাটি পেতে রাস্তার পাশে বসে থাকে। কবি আল হাফিজ দান-খয়রাত নিয়ে লিখেনÑ
রাজার নীতি বাজার প্রীতি/কেমন চমৎকার/চাঁদনী বুড়ির ভাঙ্গা থালে/খুচরো ঝনৎকার।
ঈদের দিনে তবু বুড়ির/চিকন চাঁদের ঠোঁট/আদর সেমাই পায় খুঁজে পায়/সব মানুষের ভোট।
একইভাবে কবি মুর্শিদ -উল-আলম লিখেনÑ
ঈদ এলোরে ঈদ এলো/চাঁদ উঠেছে বাঁকা/তাই না শুনে সবার মুখে/ঘুরলো হাসির চাকা।
ঈদে নতুন জামা-কাপড় পরে যেভাবে সুগন্ধি ছড়ায় তেমনি ঘরে ঘরে ভালো খাবারের ঘ্রাণও ছড়ায়। রান্না হয় ফিরনি, পায়েস ও সেমাই। কবি মনসুর আজিজ এসব মজাদার খাবার নিয়ে লিখেনÑ
আকাশ পানে তারার মেলা হাসছে মিটিমিটি
চাঁদ উঠেছে চাঁদ উঠেছে ঈদের রঙিন চিঠি।
চিঠির ভেতর কে লিখেছে খির সেমাইয়ের নাম
সাদা জামার নকশি বোনার করছে কে আনজাম?
ঈদকে নিয়ে প্রতিবছর সকল কবি ছড়াকার লিখেন অনেক ছড়া। এতে বড়রা যেমন লিখেন তেমনি তরুণরাও পিছিয়ে নেই। তরুণদের ছড়ার ঝংকারে দুলে ওঠে সবার মন। যেমনÑ কবি আহমদ বাসির লিখেনÑ
ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়ে/ফ্যাটে ও ফুটপাতে/সবাই যেন ঈদের দিনে/ভালোবাসায় মাতে।
ঈদের খুশি বাঁধ মানে না বাঁধ/এক করে দেয় সব মানুষের কাঁধ।
কবি আফসার নিজাম লিখেনÑ
একটু পরে নীল আকাশে/ফুটবে ঈদের বাতি/বাতিটাকে আনবে বয়ে/হিরক রাজার হাতি।
হাতির পিঠে সোনার গোলাপ/মুক্তা হীরার ঝালর/সেখান থেকে ঈদের বাতি/স্বপ্ন ছড়ায় আলোর।
কবি রেদওয়ানুল হক লিখেনÑ
যেই মানুষটা পলে পলে/স্বজন হারার শোকে জ্বলে/তার কাছেও ঈদটা এসে/অতুল ও অনন্য হোক।
ঈদটা সবার জন্য হোক/ধন্য চির ধন্য হোক।
আমাদের সাংস্কৃতিক বোধ সৃষ্টিতে ছড়ার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্বকে নিয়ে রচিত ছড়া ও সাহিত্যের একটি অংশ। মানুষ মাত্রই সাহিত্যের এই অংশটির প্রতি আগ্রহ পোষণ করবে এবং পড়বে এটাই স্বাভাবিক। পড়ার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান দ্বারাই মানুষ তার জীবনবোধ গড়ে তোলে। ফলে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে আমাদের বিভিন্ন পর্বকে নিয়ে লেখা ছড়া অতি গুরুত্ব বহন করে। এ ক্ষেত্রে ঈদ উৎসবের মতো সকল পর্বকে নিয়ে বেশি বেশি ছড়া লেখা উচিত। এতে পাঠকদের দায়িত্ব হলো এসব ছড়া ছড়িয়ে দেয়ার কাজে সচেষ্ট থাকা। ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশে এসব ছড়ার চাহিদা যতো বাড়বে ছড়া লেখকরাও ততবেশি আগ্রহী ও সচেষ্ট হবে।
ছড়া পছন্দ করে সকল শ্রেণীর মানুষ। সুখে-দুঃখে, আনন্দে বেদনায়, সংগ্রাম-সংঘাতে সকল অবস্থায় ছড়া সমভাবে মানুষকে আকর্ষণ করে উদ্যোমী করে। ছড়া চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মানুষকে জাগিয়ে তোলে। মানুষের মাঝে সাংস্কৃতিক বোধ জাগাতে ছড়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মানুষ স্বভাবেই সৌন্দর্যপ্রিয়। এ জন্যই মানুষ ছড়ার প্রতি আসক্ত। ছড়ার মাধ্যমে একটি বিষয়কে একজন লেখকের ছন্দে ছন্দে মানুষের হৃদয়ের কোণে প্রবেশ করে দিতে পারে। ছড়ার গাঁথুনি একটি আকর্ষণীয় শিল্প। ঈদকে নিয়ে রচিত ছড়াও একটি ব্যতিক্রমী শিল্প। মানুষ এই শিল্প চেতনায় যেন কল্যাণকর পথে অগ্রসর হয় সেজন্য ছড়ার বিস্তার প্রয়োজন। ছড়ায় ইসলামের ছোঁয়া থাকলে মানুষ অশ্লীলতা থেকে এমনকি গুনাহ থেকে রক্ষা পেতে পারে। সামাজিকভাবে ইসলামী আবহ সৃষ্টির জন্য ছড়ার ব্যাপক চর্চা হওয়া প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন এ প্রসঙ্গে জানতে হলে আমাদেরকে আরো গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
আমাদের দেশের ভূ-ভাগ ও রাষ্ট্র সত্তার বিকাশ ঘটেছে এ অঞ্চলের শত শত বছরের অব্যাহত সংগ্রাম ও সাধনার মাধ্যমে। বাংলর শতবর্ষব্যাপী মুসলিম সংস্কৃতির জাগরণ ও দীর্ঘ সংগ্রামের গতিধারা থেকেই আজকের বাংলাদেশ। শুরু থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে লালন করে আসছে।
মানুষের বিশ্বাস ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, মনমানসিকতা এবং জীবন লক্ষ্যের চেতনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জীবনবোধ এবং তারই প্রকাশ সংস্কৃতি। ছড়া সাহিত্য যেহেতু আমাদের সংস্কৃতির অংশ সে হিসেবে ধর্মীয় পর্ব নিয়ে লেখা ছড়ার বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ্য রাখাও অপরিহার্য।