অসাধারণ সুন্দর পাহাড়ের মনোরম দৃশ্যকে দ্বিগুণ করে দেয় ঝর্ণা। বাংলাদেশের ঝর্ণার কথা বললেই প্রথমেই মনে আসে বান্দরবানের শৈলপ্রপাত, কক্সবাজারের হিমছড়ির ঝর্ণা, সীতাকুণ্ডের ইকোপার্কের ঝর্ণা, সিলেটের হামহাম ও মাধবকুণ্ডের ঝর্ণা। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক ঝর্ণা আছে যা কিনা সৌন্দর্যের দিক থেকে কোন অংশে কম না।এ ফিচারে আমরা তুলে ধরবো কিছু অসাধারণ সুন্দর ঝর্ণার কথা।
জাদিপাই ঝর্ণা
বান্দরবান এর জাদিপাই পাড়ায় অবস্থিত এই ঝর্ণা। এই ঝর্ণাকে ঝর্ণার রাণী বললেও কম হবেনা। অনেকের মতে এটি নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা। ঝর্ণার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে এক মাদকাময় পাগল করা সুন্দর রুপ। প্রায় ২৫০ফুট উপর থেকে অবিরাম ঝরে পড়া পানির তিনটি ধাপে সূর্যকিরণ পড়তেই তৈরি হয় বর্ণিল রংধনু। সবার চোখের আড়াল করে বান্দবানের গহীন অরণ্যে বয়ে চলা এই ঝর্ণার নাম জাদিপাই। মিষ্টিমধুর এই কলকলানিতে পাথরের ধাপে বেয়ে নেমে যাওয়া এই ঝর্ণা পর্যন্ত পৌছাতে যতটুকু কষ্ট ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখলেই এই কষ্ট ভুলে যেতে বাধ্য। বান্দরবান থেকে রুমাবাজার হয়ে বগালেকের পরেই এই ঝর্ণা।
খৈয়াছড়া
বাংলাদেশের একমাত্র ৮ ধাপের ঝর্ণা হল মিরসরাই এর খৈয়াছড়া ঝর্ণা। বর্ষাকালে এটি বিরাট আকৃতি ধারণ করে। এই ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার পথই অনেক সুন্দর। অনেক খানি পথ পায়ে হেতে যেতে হবে। প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য উঁচু-নিচু পাহাড় আর ঝর্ণার পানির কলকল আওয়াজ শুনতে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ২.৯কি.মি শেষ করে পৌঁছে যাবেন ঝর্ণার কাছে টা টেরই পাবেন না। ধারণা করা হয় প্রায় ৫০ বছর ধরে এটি প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘের সাথে মোলাকাত করা আর সারাক্ষণ জোঁকের ভয়ে থেকে পিচ্ছিল পাহাড় বেয়ে উঠে শীতল পানিতে গোসল করার অনুভূতি অসাধারণ।এর প্রতিটি ধাপে ফুটে আছে রংধনু।এর সবগুলা ধাপ অনেক চওড়া।চট্টগ্রামের মিরসরাই বাজারে নেমে সেখান থেকে খৈয়াছড়া যেতে হবে।
পান্থমাই এর সৌন্দর্য
ভরা বর্ষায় পান্থমাই এর মত ভয়াবহ সুন্দর ঝর্ণা কম আছে।ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা এই ঝর্ণাটি অপরূপ সুন্দর।সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে মাত্র ২৫ কিমি গেলেই এই ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়।এমন দুধ-সাদা খরস্রোতা ফোয়ারা এমন,জীবন্ত ঝর্ণা পাথরের চূড়া থেকে দুর্দান্ত বেগে নেমে এসে সামনে যা কিছু আছে ভেঙ্গে চুরমার করে আছড়ে পড়ে নদীর বুকে।পান্থমাই অসাধারণ একটি জায়গা যদিও ঝর্ণাটি বাংলাদেশের সীমান্তে না তবুও অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিয়ে দূর থেকে দেখেও শান্তি পাওয়া যায়। ঝর্না ভারতের হলেও পানি এসে পড়ছে আমাদের দেশে, রূপ নিয়েছে নদীর । শীতল আর কাঁচের মত পরিস্কার পানি সৃষ্টি করেছে একখণ্ড স্বর্গ টুকরো। সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে গোয়াইনঘাট যেতে হবে তারপর ওইখান থেকে নৌকায় করে পান্থুমাই যেতে হবে।
আমিয়াখুম ঝর্ণা
বাংলাদেশের সব চেয়ে সৌন্দর্যময় স্থান গুলর মধ্যে আমিয়াখুম অন্যতম। আমিয়াখুমের দিকে যাওয়ার সময় শুধু ১টা পাহাড়ে চড়া লাগে। বিপদজনক এবং কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে দেখা মেলে সে অদেখা স্বর্গ আমিয়াখুম সব কষ্ট, ক্লান্তি নিমেষে হারিয়ে যায় ,মনে হয় কি এমন কিছু ছোয়া পেয়ে সব ক্লান্তি, অবশাদ দুর হয়ে যায়।পানিটা এখনও দুষনমুক্ত।প্রায় হাজার ফুট খাড়া দুই পাহাড়ের কোলে এঁকেবেঁকে এলাকা রাঙ্গিয়ে দেয়া এই পানির ধারা ছুটে চলেছে সিঁড়ির পর সিড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে।আমিয়খুমের দুই পাশের পাহাড় সম্পূর্ণ দুই রকমের। প্রশস্ত সিঁড়ির পর সিঁড়ি একেকটা ধাপ এত বড় যে এসব ধাপে তাবু টানিয়ে ঘুমানো যাবে।এর সৌন্দর্য শুধু শব্দের বর্ণনায় শেষ করা যাবে না। জ্যোৎস্না রাতে আমিয়াখুম মনে হবে অন্য ভুবনে রয়েছেন। সন্ধ্যা নামতেই দিনের উত্তাপ মিলিয়ে শীতল হাওয়ার আবির্ভাব।উপরে মেঘহীন আকাশে নিযুত নক্ষত্ররাজির যখন স্পষ্ট বিচরন, তখনই দুই পাহাড়ের দৃশ্যত মিলন স্থলের ঠিক মাঝ দিয়ে উদিত হওয়া পূর্ণিমার চাঁদ যা আমিয়খুমের রাতকে করে তুলে স্বাপ্নিক, পরিপূর্ণ। বান্দারবান থেকে থানচি হয়ে যেতে হয় আমিয়াখুমে।
মাধবকুন্ড ঝর্ণা
মাধবকুন্ড ঝর্ণা যা বাংলাদেশের সুউচ্চ জলপ্রপাত হিসেবে পরিচিত। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা নামক উপজেলায় এই সুন্দর নয়নাভিরাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। একসময় পর্যটকদের কাছে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত মানেই ছিলো মাধবকুন্ড। এখন দেশের ভেতরে আরো অনেক ঝর্ণার সন্ধান মিলেছে। তবে এখনো জলপ্রপাত অনুরাগী পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন মাধবকুন্ড ঝর্ণা। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এই স্থানটিতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক।
যে পাহাড়টির গা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ পাহাড়টি সম্পূর্ণ পাথরের যা পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) নামে পরিচিত। এর বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে ছড়া। এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। অর্থাৎ গঙ্গামারা ছড়া হয়ে বয়ে আসা জলধারা [১২ অক্টোবর ১৯৯৯-এর হিসাবমতে] প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচে পড়ে মাধবছড়া হয়ে প্রবহমান। সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে, বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে। জলের এই বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। এই মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতে হতে গিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে। মাধবকুন্ড ঝর্ণা থেকে ১৫-২০ মিনিটের হাটা দুরত্বে রয়েছে আরেকটি ঝর্ণা যা পরিকুন্ড ঝর্না নামে পরিচিত।
পরিকুন্ড ঝর্না
পরিকুন্ড ঝর্ণাটি অনেকের কাছেই অপরিচিত বলে মনে হতে পারে। অনেকেই মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের পাশেই বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কর একটি ঝর্নার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে জানেই না।
সিলেটে বর্ষায় এর চেয়ে সুন্দর ঝর্না আর হতেই পারেনা। ঝর্নার স্বল্প গভীর কুয়াতে সাঁতার কিংবা গোসল করা যায় ইচ্ছেমত।এটি তুলনামূলক কাছে কিছুটা কম পরিচিত হলেও সৌন্দর্য মোটেও কম নয়। এ ঝর্ণাটি মাধবকুন্ড ঝর্ণা থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে, ৫ মিনিটের ছোট্র একটি ঝর্ণা কিন্তু চমৎকার ও কোলাহল মুক্ত এবং ঝর্ণার নিচে একটি কূপ আছে। ৫০ ফুট উচু খাড়া পাহাড় হতে এই ঝর্নার পানি নিচের দিকে পতিত হয়েছে। জল ও পাথরের সংঘর্ষে জলকনাগুলো উড়ে গিয়ে মৃদু কুয়াশার সৃষ্টি করে। অসংখ্য প্রজাতির গাছপালা দ্বারা ঝর্নাটির চারপাশ আচ্ছাদিত হয়ে আছে। সেই সাথে পাখির কিচির-মিচির বনের নিস্তব্ধতাকে জাগিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। ঝর্নার অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য করার জন্য প্রাকৃতিক আসন হিসেবে রয়েছে অসংখ্য পাথর। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত থেকে মাত্র পাচ মিনিট ছোট একটা ঝিরি পথে হাটলেই এই বুনো ঝর্না।