এ এফ এম ফৌজি চৌধুরী : :

সমাজে শিশু নির্যাতন ও হত্যার হার মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়ে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। ইদানীং মানুষের আক্রোশ ও জিঘাংসা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। যার নিষ্ঠুর শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। বেশির ভাগ সময়ে তাদের অপহরণের পর কিংবা পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অভাব, হাহাকার, হতাশায় বাবা-মাও নিজের সন্তানকে হত্যা করছেন অবলীলায়। এ ছাড়াও সামান্য অপরাধে শিশুকে অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। এটা অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজেরই এক ভয়াবহ চিত্র। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা যখন ‘কম্পিউটার গেম’ নিয়ে ব্যস্ত তখন এ দেশের শিশুরা করছে অমানবিক পরিশ্রম। বেঁচে থাকার সংগ্রামে উপার্জনে নেমেছে। বন্ধ হচ্ছে তাদের মেধা বিকাশের পথ। বাস্তবতার মুখে শিশুরা নিজেই নিজেদের সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছে। চোখে মুখে অপুষ্টির চিহ্ন নিয়ে ছোট ছোট রোগাক্রান্ত দেহগুলোকে শতছিন্ন করে, লিপ্ত হয় নানা কাজে। গ্রামে-গঞ্জে শিশুরা সাধারণত ক্ষেত খামারে কাজ করে। শহরে কেউ কেউ বাসাবাড়ি, চায়ের স্টলে, দোকানে কাজ করে। কেউ কেউ বাজারে, স্টেশনে কুলিগিরি করে, বাস-ট্রাকের হেলপারি করে, কেউবা চালায় রিকশা, কেউবা ভাঙে ইট। এভাবে তারা পরিণত হয় অগণিত শিশু শ্রমিকে।images-jpxsg

শিশুদের মধ্যে লক্ষ্য করলে দেখা যায় অনেকেই মাদকাসক্ত। এদের সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে গাঁজা, চরস, আফিম আর হেরোইনের সাম্রাজ্যে। এমনকি অনেক শিশুকে জোরপূর্বক পঙ্গু করে নিয়োজিত করা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। মনুষ্যত্বহীন বিবেক বর্জিত অমানুষরা বিপুল বিত্ত-বৈভবের আশায় আজ শিশুদের অপহরণ করছে। ধরা পড়লে শিশুরা যেন পুলিশকে সঠিক তথ্য না দিতে পারে সে জন্য তাদের স্মৃতিশক্তি পর্যন্ত নষ্ট করে দেয় ওই পাষণ্ডরা। সুযোগ বুঝে শতসহস্র শিশুকে পাচার করে তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিদেশে বিক্রি করা হয়। আবার কাউকে বিক্রি করা হয় উটের জকি হিসেবে। যেখানে এই হচ্ছে এ দেশের শিশুদের জীবন চিত্র ও অধিকার, সেখানে ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ’ পালন এদের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না।

শিশুদের প্রতি করুণা নয় বরং দেশের স্বার্থেই তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, তথা রাষ্ট্রের। শিশুর নিরাপত্তা দিতে হবে সবার আগে পরিবারকে তারপর সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে যা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। শিশুদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে তাদের কল্যাণের ব্যাপারে সরকারকে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা উচিত। অপার সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে যে শিশুর নিরাপদে বেড়ে ওঠার কথা সে কেন নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হবে? শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ত্বরান্বিত করতে সবার আগে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমাজের একশ্রেণির অমানুষের লোভ ও নিষ্ঠুরতার কারণে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হবে, তাদের প্রাণ চলে যাবে এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

দেশে পরপর কয়েকটি নৃশংস শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। তার মধ্যে গত ৮ জুলাই ২০১৫ সিলেটের শিশু সবজি বিক্রেতা শেখ সামিউল আলম রাজনকে চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে একদল দুর্বৃত্ত পিটিয়ে হত্যা করে। ৩ আগস্ট ২০১৫ খুলনায় নগরীর টুটপাড়া করবস্থান মোড়ে ‘শরীফ মোটরস’ নামে একটি ওয়ার্কশপে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেয়ার কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে শিশু রাকিব সরদারকে (১২) হত্যা করে। বাংলাদেশে জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী নিতুর সম্মিলিত অমানবিক নির্যাতনের শিকার মাহফুজা আক্তার হ্যাপি নামের গৃহকর্মী। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল সাড়ে ৮টায় লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর চণ্ডিপুর ইউনিয়নের মাসিমপুর বাংলা বাজারে বিল্লাল পাটোয়ারীর দোকানের সামনে সামান্য দুটি নারিকেল চুরির অভিযোগে ইয়াছিন হোসেন (১০) নামের এক শিশুকে দোকানের পাকা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীর একটি বাসা থেকে ১০ শিশু উদ্ধার করে পুলিশ। রামপুরা থানা পুলিশ দুপুরে বনশ্রী আবাসিক এলাকার সি-ব্লুকের ১০ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর বাসার ষষ্ঠ তলায় অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন নামে এক এনজিও অফিসে অভিযান চালায়। এ সময় সেখান থেকে ৮ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুদের উদ্ধারের পাশাপাশি এক নারীসহ চারজনকে আটকও করা হয়। ধারণা করা হয়, ওই শিশুরা পাচারের শিকার হয়েছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার ঘাটের ছটি যাত্রাপুর গ্রামে আবুল হোসেনের ছেলে শিশু কামরুলকে নৌকা নিয়ে মাছ ধরার বিরোধের জের ধরে ওই দিন রাত ৮টার দিকে পথ থেকে ধরে নিয়ে রাতভর চালানো হয়েছিল পৈশাচিক নির্মমতা। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ যশোরের কেশবপুরে হাবিব সিড ফার্মের মালিক তাহের আলীর ছেলে শামছুর রহমানের একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়। এ ঘটনায় ১২ বছরের শিশু শরিফুল ইসলাম চোর শনাক্ত হয়। এরপর থেকে চলতে থাকে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন। ২১ সেপ্টেম্বর ১২টার দিকে তাহেরের পরিবারের লোকজন কাজের ছেলে শরিফুল ইসলামকে মারপিট করে ঘরে আটকে রাখে। বিকাল ৩টার দিকে ওই বাড়ি থেকে সে পালানোর চেষ্টা করলে এক পর্যায়ে তাহের ও তার ছেলে শামছুর রহমান পশুহাট থেকে তাকে ধরে এনে পুনরায় মারপিটসহ তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর এক পর্যায়ে তার মৃত্যু হয়। ২ অক্টোবর ২০১৫ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের গোপাল চরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আট বছরের শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভ সংসদ মো. মনজুরুল ইসলাম লিটনের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়।

গত ৮ নভেম্বর সিলেটের শিশু রাজন ও খুলনার রাকিব হত্যা মামলার রায় প্রদান করে আদালত। রাজন হত্যাকাণ্ডের দায়ে প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম, ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও জাকির হোসেনকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করেন আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন নুর মিয়ার। রাজন হত্যার দায়ে আদালত দুই আসামি ওমর শরীফ ও মিন্টু মিয়াকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। এক আসামি বিউটি বেগমকে খালাস দেয়া হয়েছে। সিলেট ও খুলনায় অপরাধ প্রমাণ হয়ে সাজা হলেও গাইবান্ধায় এসে তা যেন উল্টে গেছে। রাজন-রাকিবের রায়ের দিন প্রহসন ছিল শিশু শাহাদাত হোসেন সৌরভকে যিনি গুলি করেছিলেন তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন, কারণ তিনি একজন এমপি। সংসদ অধিবেশন শুরু হচ্ছে তাই তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এর আগে তার জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে তিনবার। একজন এমপি হিসেবে অবশ্যই তার দায়িত্ব সংসদের অধিবেশনে থেকে কার্যপ্রণালিতে অংশগ্রহণ করা। কিন্তু বিচার ব্যবস্থার দিকে যখন জনগণ তাকিয়ে একটু স্বস্তি পেতে চাচ্ছে ঠিক তখনই লিটনের মুক্তি, তার গলায় গাঢ় কমলা রঙের গাঁদা ফুলের মালা দেখে অনেকেই আঁতকে উঠেছেন। এই সাংসদের গাড়ি ব্যবহার করেই তিনি একটি শিশুকে পায়ে গুলি করেছেন। গুলিটি পায়ে না লেগে বুকে লাগলে শিশুটি মারা যেতে পারত। তিনি মুক্তি পাওয়ার পর পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘সেই গাড়িতে চড়েই ফিরলেন বাড়ি’। অন্য একটি পত্রিকা গাড়ির রঙ উল্লেখ করে লিখেছে ‘সেই লাল গাড়ি’। তার অর্থ হচ্ছে একজন সংসদ সদস্যের গাড়ির রঙও একটি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। শিশু সৌরভ প্রাণে বেঁচে গেছে ঠিক; কিন্তু তার সারা জীবন পড়ে আছে সামনে এই লাল গাড়ির আতঙ্কে।

শিশু রাজন ও রাকিব হত্যার মামলার রায় প্রত্যাশিত সময়েই সম্পন্ন হলো। তবে শুধু রায় প্রদানই শেষ কথা নয়, এই ঘৃণ্য অপরাধীদের দেয়া দণ্ড কার্যকর হতে হবে। তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অর্থ দিয়ে বশ করে যেমন বিদেশে পালিয়ে যেতে পেরেছিল; তেমনভাবে কাউকে বশ করে দণ্ড থেকে রেহাই যেন না পায়। আমরা এই নৃশংসতম খুনিদের রায় কার্যকর দেখতে চাই।

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *