সুন্দরবনের বিপন্ন পাহারাদার

ma2
প্রকৃতির অপরূপ রঙ আর শিল্পীর জলতুলির আঁচড়ে আঁকার মতো সুন্দরবন বৈচিত্র্যময় এক নিদর্শন। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এই বনে রয়েছে ৪৪০টি বাঘ, দেড় লাখ হরিণ, ৫০ হাজার বানর, দেড়শ’ থেকে ২০০ কুমিরসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদাচর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপ। সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বয়ে চলা বঙ্গোপসাগর সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ কাউন্সিল এই বনকে বিশ্ব ঐতিহ্য অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ৬০০০ বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবন আমাদের অর্থনীতিতে রাখছে অনেক বড় ভূমিকা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের কারণে সুন্দরবন আজ বিপন্ন। হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি, উদ্ভিদ ও জলজপ্রাণী। এমনকি বাংলাদেশের অহংকার সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। বন বিভাগের কাছে ৪৪০টি বাঘের হিসাব থাকলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান ২০০৬ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে শুমারি করে ২০০টির মতো বাঘ পান। ২০০৯-১৭ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় একটি অ্যাকশন প্ল্যান চলছে বন বিভাগের। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান। তিনি জানান, যদি এই প্ল্যান মতো কাজ করা যায় তাহলে বাঘের সংখ্যা, বাঘে-মানুষের দ্বন্দ্ব, মানুষের সচেতনতা ইত্যাদি সম্পর্কে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আগামী শীত মৌসুমে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে বাঘ শুমারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাঘের সংখ্যা জানতে সাহায্য করবে। যেভাবেই বাঘ শুমারি হোক না কেন অনেকেই মনে করছেন বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমছে বৈ বাড়ছে না। আর এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। বন উজাড় হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতায় সমুদ্রে পানির স্তর বেড়ে আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। বাঘের খাবার কমে যাচ্ছে। সুন্দরবনের আশপাশের বন উজাড় করে ক্রমশ বেড়েই উঠছে মানুষের বসতি। আর বাঘ তার বসতি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে লোকালয়ে। আতংকেই হোক আর অর্থের লোভেই হোক, মানুষের শিকারে পরিণত হচ্ছে বাঘ। মানুষও যে বাঘের শিকারে পরিণত হচ্ছে না তা নয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছর দেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, পঞ্চগড়, বাগেরহাট জেলাতে প্রায় ৩৫ জন মানুষের জীবন গেছে বাঘের কবলে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বাঘ বিশারদ ম্যাক হন্টারের বক্তব্য থেকে জানা যায়- সুন্দরবনের বাঘ বন ছেড়ে লোকালয়ে আসছে ৫টি কারণে- ১. সুন্দরবনে সাম্প্রতিক সময়ে পানিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, ২. ক্ষুধা অনুযায়ী খাবার মিলছে না, ৩. খাবার শিকারে বয়স্ক বাঘের অক্ষমতা, ৪. নদীর নাব্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, ৫. শিকারিদের অত্যাচার।
অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খানের গবেষণা তথ্যমতে, প্রতি বছর চোরাশিকারিদের হাতে গড়ে ৩ থেকে ৫টি বাঘ মারা পড়ে। তারা চামড়া আর হাড়ের জন্য বাঘ শিকার করে। এ ছাড়া বছরের প্রতি শীত মৌসুমে গোলপাতা, কাঠ আর মাছ ধরতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের সমাগমে দিন দিন উজাড় হচ্ছে সুন্দরবন। বনে জেলেরা বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্র“য়ারি মাস পর্যন্ত এবং বনজীবীরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থানের কারণে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না এই বন সুন্দরী। ব্যাপক হারে গোলপাতা আর গাছ উজাড়ের ফলে বনে বাঘের ঘরে টান পড়ছে। যে কারণে বাঘের বিচরণ এখন আর তার নিজস্ব অঞ্চলের মধ্যে থাকছে না। দিন দিন আশ্রয়ের অভাবে বন থেকে বাঘ চলে আসছে লোকালয়ে। ঘটছে প্রাণহানি।
মানুষ প্রকৃতিকে উজাড় করে ভোগ করার কারণে সুন্দরবন আর এখন সুন্দর নেই। গেল কয়েক বছরের মধ্যে ঘটে গেল সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন। সুন্দরবনকে তছনছ করে দিয়েছে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যে কারণে খাদ্যাভাবে একদিকে কমেছে বাঘের খাদ্য হরিণ, অন্যদিকে বাঘের সংখ্যাও। জীবনচক্র পরিক্রমায় প্রাণী বেড়ে ওঠে অন্য প্রাণীকে আহার করে। সুন্দরবনে সেই জীবনচক্র আজ অনেকটাই কাজে আসছে না। প্রত্যেকটি বাঘেরই স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হল বনে তাদের আহার, বসবাস এবং শাসন সীমারেখা তৈরি করা থাকে। কেউ যদি সেই সীমা পেরিয়ে বা অন্যের সীমানায় ঢুকে পড়ে তাহলে বেধে যায় তীব্র লড়াই। ওই লড়াইয়ে পরাজিত বাঘ হেরে গিয়ে অনেক সময় বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পরে শুধু নিজেকে বাঁচানোর আশায়। এতসবের পরেও যে কারণটা বন্যপ্রাণীর জন্য অসহনীয় তা হল, সুন্দরবনের জলে লবণাক্ততা। বনে আসা মিষ্টি জলের চ্যানেল হিসেবে খ্যাত নদীগুলোতে পলি জমার কারণে নাব্য হারিয়ে ফেলায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি জল আসছে না বনে। যে কারণে প্রাণীকুল জীবন বাঁচাতে নতুন জায়গা খুঁজছে। বৈশ্বয়িক জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বাঘসহ অন্য প্রাণীকুলের বাসস্থান ও আচরণের ওপর প্রভাব পড়ছে।
বাঘ না থাকলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব কতটুকু থাকত সেটা ভেবে দেখার বিষয়। আজ শুধু সুন্দবনের বাঘই নয়, সুন্দরবনই বিপন্ন। বিপন্ন এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। সুন্দরবনকে সুন্দর করতে সবার আগে দরকার সচেতনতা। কার্যকরী সরকারি উদ্যোগ। ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাংকের জরিপে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশের মানুষের অজানা নেই যে, সুন্দরবন দুর্যোগে মানুষ বাঁচাতে বুক পেতে দিয়েছে। আজ সুন্দরবনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। সুন্দরবন বাঁচলে বাঁচবে বাংলার অহংকার সুন্দরবনের পাহারাদার বেঙ্গল টাইগার।
লেখক : গবেষক ও পরিবেশবিষয়ক লেখক –

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *