ডিজিটাল বিপ্লবের এই যুগে আপনার শিশুর জন্য বাস্তবের জগত্ ও ভারচুয়াল জগতের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করে দিন। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা শিশুর প্রযুক্তি-আসক্তি ঠেকাতে এ ধরনের পরামর্শই দিচ্ছেন।
গবেষকেরা বলছেন, এখনকার শিশুরা প্রযুক্তিপণ্যে এতটাই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে যে, শিশুর হাত থেকে মোবাইল ফোন বা ট্যাব কেড়ে নিলে তারা রেগে যায় বা নেতিবাচক আচরণ শুরু করে। তারা অন্য কোনো দিকে খেয়াল করে না, কারও সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। তারা মোবাইল, ট্যাবলেটে চোখ রাখে বেশি সময়। এতে পারিবারিক বন্ধনের ধারণায় পরিবর্তন আসছে।
মনস্তাত্ত্বিকেরা দাবি করছেন, প্রযুক্তিপণ্য শিশুদের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। অনেক শিশু এখন ট্যাব, স্মার্টফোনে গান না শুনে বা ভিডিও না দেখে খেতে চাইছে না। অভিভাবকের দৃষ্টিকোণ থেকে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মোবাইল ডিভাইস ও বাস্তবের জগতের যোগাযোগের মধ্যে সীমানা তৈরি করে দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
আমেরিকান অ্যাকাডেমি ও পেডিয়াট্রিকসের বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে দেওয়া উচিত নয়। তাদের সামনে প্রযুক্তিপণ্য উন্মোচন করা ঠিক নয়। শিশুর বয়স তিন থেকে পাঁচ বছর হলে দৈনিক বড়জোর এক ঘণ্টা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত।

তবে এখনকার বাস্তবতায় শিশুদের খেলার উপযোগী মাঠের অভাব এবং হাতের নাগালে প্রযুক্তিপণ্য থাকায় শিশুদের প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে তদারকি কম করা হয়। ফলে শিশুরা অতিরিক্ত সময় ধরে প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন শিশুরা কমপক্ষে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে টিভি দেখে বা কোনো প্রযুক্তিপণ্যে গেম খেলে সময় কাটায়। শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবার প্রযুক্তিপণ্যের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত জেনে যায়। তবে প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের কিছু শিক্ষণীয় দিকও রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকেরা। এখনকার শিশুরা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে কোনো কিছু শেখা, ধাঁধা সমাধান করা, শব্দভান্ডার বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো শিখে নিতে পারে। এখন শিক্ষার একটি টুল হিসেবেও প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার দেখা যায়।

শিশুরা ভারচুয়াল পদ্ধতিতে যোগাযোগ পছন্দ করে। কিন্তু অতিরিক্ত সময় ভারচুয়াল জগতে থাকার ফলে তার সামাজিক দক্ষতাগুলো ঠিকমতো তৈরি হয় না এবং ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও দেরি হতে পারে। গবেষকেরা বলেন, মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোতে প্রযুক্তি-আসক্তির কারণে শিশুদের স্থূলতার সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও তাদের ঘুমের সমস্যাও তৈরি হতে পারে।

ভারতের লীলাবতি হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ভারত শাহ বলেন, ‘কম বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি-আসক্তির বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি দেখা গেছে। প্রযুক্তিপণ্য নিয়ে শিশুদের অভ্যাস তৈরির আগেই অভিভাবকদের এ ধরনের পণ্য ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।’

শিশুদের প্রযুক্তি-আসক্তি দূর করতে অভিভাবকের নিজেদের এ ক্ষেত্রে অভ্যাসের পরিবর্তনও জরুরি বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।

 

শিশুদের হাতে কখন দেবেন মোবাইল?

সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়স কত হওয়া উচিত? জানতে চাওয়া হলে একেকজনের উত্তর একেক রকমই হবে। সন্তানকে মোবাইল ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে তার অভিভাবককে সন্তানের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। মোবাইল ফোনটি কি সন্তানের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়? নাকি অন্যদের আছে বলেই এ আবদার। সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার সময় প্রথমেই বিবেচনায় আনা উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোনের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আবার অনেক স্কুলে নিয়ম মেনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি থাকে তার পরও মোবাইল কিনে দেওয়ার আগে অভিভাবককে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে সন্তানের আচরণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্যান্য উপকরণের প্রতি সন্তানের আচরণ কেমন সে বিবেচনায় অভিভাবককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া সঠিক হবে কি না। শিশুদের সব সময় তত্ত্বাবধানে রাখা হলে এ বয়সে তার হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়াটা অযৌক্তিক। তবে সন্তান

যদি লেখাপড়া বা অন্যান্য কাজে দায়িত্বশীল হয় এবং অস্থিরমতি না হয় তাহলে তার কাজের পুরস্কার বা ভালো ফলের পুরস্কার হিসেবে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া যেতে পারে। সন্তানের হাতে পুরস্কার হিসেবে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া হলে সে আরও বেশি দায়িত্বশীল ও উদ্যমী হতে অনুপ্রেরণা পাবে। সন্তান যদি লেখাপড়ার বাইরে অন্যান্য কাজের সঙ্গেও যুক্ত হয় তখন তার মোবাইল ফোন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

মোবাইল ফোন ব্যবহার করে মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ রাখতে পারে সন্তান। শিশুকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অনেক বেশি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে সক্রিয় হতে হবে, এ বিষয়টি এত জরুরি নয়। সামাজিক হওয়ার ক্ষেত্র বাড়াতে মোবাইল ফোন ছাড়াও অন্য বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে বাজারে থাকা বিভিন্ন স্মার্টফোন শিশুদের হাতে তুলে দিলে তাদের মোবাইল ফোনের ব্যবহার বিষয়ে খবর রাখাটা কঠিন। সন্তানদের নজরদারির মধ্যে রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার আগে খেয়াল রাখতে হবে নিরাপত্তার বিষয়টি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমটি মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক। অনেক জরুরি মুহূর্তে সন্তানের কাছে মোবাইল ফোন থাকলে সব ধরনের খোঁজখবর রাখা সম্ভব হয়। দ্বিতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি হচ্ছে, মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকটি। এ বিষয়টি মা-বাবার চোখ এড়িয়ে যায়। শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার আগে ইন্টারনেটে নিরাপত্তার বিষয়টি অভিভাবককে ভেবে দেখতে হবে। সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার সঠিক বয়স নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ, সব ধরনের শিশুর ক্ষেত্রে বয়সসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। দায়িত্বশীলতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে এটা মা-বাবাকেই ঠিক করতে হবে। তবে শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার আগে তার বয়স উপযোগী মোবাইল ফোন পছন্দ করতে হবে। পরিবারের ছায়া সন্তানের ওপর পড়ে তাই পরিবারের অভিভাবক হিসেবে নিজের জন্য ও নিজের সন্তানের জন্য উপযোগী মোবাইল ফোন কিনতে হবে। শুধু লোক দেখানোর জন্য স্মার্টফোন শিশুর হাতে তুলে দেওয়াটা কখনো যৌক্তিক হবে না।

(তথ্যসূত্র: জিনিউজ ও ম্যাশেবল)

নিচে শিশুদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে একটি ভিজুয়াল প্রতিবেদন দেয়া হলো ।

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *