শুরুর কথা………
আজকের শিশু জাতির সোনালী ভবিষ্যতের স্থপতি । সুন্দর কল্যাণকর জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন সুন্দর পরিবেশ যেখানে জাতির ভবিষ্যত স্থপতিগণ সকল সম্ভাবনাসহ সুস্থ,স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্নিক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারবে । শিশুদের জন্য এরূপ একটি পরিবেশ গঠন কারো দয়া বা অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না । এজন্য প্রয়োজন শিশুর অধিকার সম্বলিত উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তার সফল বাস্তবায়ন । এই বাস্তব সত্য উপলব্ধি করে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে শিশু অধিকারের উপর বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে । বাংলাদেশও পরিবর্তনশীল সময়ের দাবী অনুযায়ী শিশু অধিকারের উপর বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে ।
দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিশুদের জন্য সুষ্ঠু কার্যক্রম গ্রহণ অপরিহার্য ৷ প্রত্যেক শিশুকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্ঠায় সকলের অংশগ্রহণ একান্ত বাঞ্জনীয় ৷ শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার ৷ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শিশুদের উন্নয়নের সার্বিক কার্যক্রম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন ৷
শিশু অধিকার ও আমাদের শিশু
(আশরাফুল ইসলাম)
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যৎ। তারা শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, চিন্তায়-চেতনায় ও মননে যত সমৃদ্ধ হবে জাতির ভবিষ্যৎ তত শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। দারিদ্রের কষাঘাতে বহু শিশু তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার, জীবনযাত্রার মান ভোগ ও বিনোদনের অধিকার ইত্যাকার নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা অভাবের তাড়নায় তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করছেন। আবার ছিন্নমূল শিশুরা পেটের তাকিদে নিজেরাই টোকাই হচ্ছে, ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে. কোন কোন ক্ষেত্রে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। শিশুদের এহেন অবস্থা থেকে রক্ষার আইন আছে, সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সনদ ও প্রতিশ্রুতি আছে কিন্তু এগুলো প্রতিপালিত হচ্ছে না। জাতির কর্ণধার, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের তাই এই দিকটায় বিশেষ নজর দেয়া দরকার। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শিশুদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার বিষয় উপেক্ষা করছেন। যার ফলে শিশুদের কিছু অস্বাভাবিক আচরণও পরিলক্ষিত হচ্ছে। যাহোক, জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সমাজের সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে। তাহলেই কেবল জাতির বিপন্ন শিশুদের রক্ষা করা যাবে।
শিশু অধিকার
শিশু অধিকার সনদে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো : ১. শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার, যেমন স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ; ২. বিকাশের অধিকার, যেমন শিক্ষার অধিকার, শিশুর গড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত একটি জীবনযাত্রার মান ভোগের অধিকার এবং অবকাশ যাপন বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার; ৩. সুরক্ষার অধিকার, যেমন শরণার্থী শিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু, শোষণ নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন শিশু; ৪. অংশগ্রহণের অধিকার, যেমন শিশুদের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, অন্যান্যের সাথে অবাধে সম্পর্ক গড়ে তোলার অধিকার এবং তথ্য ও ধারণা চাওয়া পাওয়া ও প্রকাশের অধিকার।
শিশুর অপুষ্টি
বাংলাদেশের শিশুপুষ্টির চিত্র এখনো আশানুরূপ নয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিভাবকের দারিদ্রতার পাশাপাশি অজ্ঞতার কারণেও শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। এছাড়া খর্বকায়, বয়সের তুলনায় কম ওজনসহ নানা রোগব্যাধিতে ভোগে শিশুরা। শিশুপুষ্টির অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডের সূচক অনুসারে একটি দেশে শতকরা ৪০ ভাগ বয়সের তুলনায় বেঁটে, শতকরা ৩০ ভাগ বয়সের তুলনায় কম ওজন এবং শতকরা ১৫ ভাগ উচ্চতার তুলনায় কম ওজন হলে মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সূচক হিসেবে সবক’টি ক্ষেত্রেই নিচে রয়েছে বাংলাদেশ। অভাবে মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত এমনকি ধনী পরিবারের শিশুরাও অপুষ্টিতে ভোগে এবং বিভিন্ন সমস্যার কারণে মারা যায়।
খাদ্য নিরাপত্তা ও জাতীয় নজরদারি প্রকল্পের (এফএসএনএসপি) সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনো শিশু পুষ্টিহীনতার উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুব ধীর। এখনো এটি উচ্চহারে অবস্থান করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের আনুপাতিক হিসেবে এটি বরং আরো বাড়ছে। রিপোর্ট অনুযায়ী এই হার ৪৫ শতাংশে অবস্থান করছে। এটি বাংলাদেশের শিশুপুষ্টির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। জাতিসংঘের বিশ্ব পুষ্টি পরিস্থিতি বিষয়ক ষষ্ঠ রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪০.২ শিশুই অপুষ্টির শিকার। এদেশে প্রতিদিন ২৫০ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করে। ইউসেফের তথ্য মতে, দেশে অপুষ্টির শিকার শিশুর সংখ্যা প্রায় এক কোটি।
বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য সেবা (বিডিএইচএস) ২০১১ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ বয়স অনুযায়ী কম ওজন সম্পন্ন, ৪১ শতাংশ খর্বকায় এবং ১৬ শতাংশ কৃশকায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভ্রƒণ থেকে পরবর্তী তিন বছর বয়সটা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কের ৭৫-৮০ ভাগ বিকাশ ঘটে এই সময়ের মধ্যে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সে ১৫ ভাগ এবং পাঁচ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অবশিষ্ট ৫ ভাগের বিকাশ ঘটে। অপুষ্টির শিকার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঠিকমত হয় না। বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতির হার কম। সৃজনশীল কাজেও তারা পিছিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবার তিন বেলা খেতে পায় না। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে বঞ্চিতদের মধ্যে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের অপুষ্টিজনিত সমস্যা থেকেই মূলত শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। শিশুর অপুষ্টি ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর দুটি প্রধান কারণ হলো সঠিকভাবে মায়ের দুধ না খাওয়ানো এবং সঠিকভাবে পরিপূরক খাবার না খাওয়ানো। দারিদ্রতার পাশাপাশি মা-বাবার অসচেতনতা, সামাজিক কুসংস্কার ও অভ্যাস শিশুর পুষ্টিহীনতার জন্য দায়ী। পুষ্টিহীন শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। সেকারণে এরা খুব সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
শিশু শ্রম
বিদ্যমান শ্রম আইনে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও ব্যাপক সংখ্যক শিশু ঘরে ও বাইরে অর্থাৎ কলকারখানা, ওয়ার্কশপ, রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, মোটর গ্যারেজ, বাস ও টেম্পো, নির্মাণ কাজ, চা বাগান, কৃষি ও গৃহকর্মে নিয়োজিত। এসব কাজে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমিকের ১২ শতাংশই শিশু শ্রমিক। কম মজুরি, মাত্রাতিরিক্ত খাটুনি ও ঝুঁকিপূণ শ্রম নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে আমাদের দেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতি। শিশুরা এসব কাজে নিয়োজিত থেকে অনেক সময়ই কেবল জীবনধারণের খোরাকি পেয়ে থাকে, যা দয়া-দক্ষিণা বলেও বিবেচিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের কাজগুলোকে দাসতুল্য বলা হয়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দরিদ্র শিশুরা ট্যানারি, প্লাস্টিকের কারখানা, ওয়ার্কশপ কেমিকেল হাউজসহ বাসাবাড়িতে নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
এইসব কারখানার পরিবেশ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যেমন অন্তরায় তেমনি যেকোন মুহূর্তে দুর্ঘটনারও আশঙ্কা থেকে যায়। শিশুদের এসব স্থানে দিনে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।
বাংলাদেশে অন্তত ৪৫ লাখ শিশু নিষিদ্ধ শিশু শ্রমে জড়িয়ে আছে। তারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের দুরন্ত শৈশব। নিয়মিত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে ওদের সোনালি ভবিষ্যৎ। পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জরিপ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে মোট ৪৫ ধরনের কাজে। এর মধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজেই শিশুরা অংশ নিচ্ছে। গত পাঁচ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ১০ লাখ। মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। সরকারি হিসেবে দেশে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শিশুশ্রমের প্রবণতা অনেক বেশি।
শিশু শ্রমিকদের মধ্যে আবার ১৫ লাখ শহরে এবং ৬৪ লাখ গ্রামে কাজ করে। এদের মধ্যে ৭৩ ভাগ ছেলে এবং ২৭ ভাগ মেয়ে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে আইএলও কনভেনশন ১৩৮-এ অনুস্বাক্ষরের আয়োজন চলছে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী একটি শিশুকেও তার জীবন নির্বাহের জন্য কোন প্রকার শ্রমে নিয়োজিত করার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পেক্ষাপটের কারণে শিশুরা শ্রমে জড়িত হয়ে থাকে। একই কারণে অভিভাবক ও মালিক উভয়েই শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত করে। কাজেই আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমেই কেবল শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব হবে। আর এ জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
শিশু আইন
বাংলাদেশ অতি সম্প্রতি পাস হয়েছে শিশু আইন ২০১৩। এই আইনে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বে থাকা কোন শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন বা অবহেলা করেন তাহলে ঐ ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইন অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলে গণ্য করা হবে। মিছিলে, সমাবেশে শিশুদের ব্যবহার করা এখন দণ্ডনীয় অপরাধ। শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনপল্লীতে ব্যবহার করা হলে অথবা শিশুদের দিয়ে কোন প্রকার মাদক বা আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ কিছু বহন করানো হলে দায়ী ব্যক্তিকে সাজা দেয়া হবে। ইচ্ছে করলেই কোন ধরনের মামলায় নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই গ্রেফতার করা যাবে না। নয় বছরের বেশি কোনো শিশুকে গ্রেফতার বা আটক করা হলে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি পরানো যাবে না। এছাড়া যে কোনো মামলায় শিশুকে জামিন দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। শিশু সংক্রান্ত মামলা দেখাশুনা করবেন নিয়োগ পাওয়া প্রবেশন কর্মকর্তা। আর শিশুর বিচার হবে বিশেষ শিশু আদালতে।