জিবলু রহমান ।। বৃটিশ পরাধীনতার যুগে ১৯১৮ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষাকে অভিভক্ত ভারতের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি জানান। ১৯২১ সালে নবাব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষাকে বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব পেশ করেন। সেই সূত্র ধরেই দৈনিক আজাদ ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল ‘ভারতের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের পূর্বেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিতব্য ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেহাদ, সাপ্তাহিক মিল্লাত, মাসিক সওগাত, মাসিক মোহাম্মদীতে অনেকের রচনাই সেই দাবি বিধৃত। ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বিভিন্ন পত্রিকায় তো বটেই, অনেকেই ‘পাকিস্তান’ বিষয়ক গ্রন্থেও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বিধৃত রয়েছে। মুজিবুর রহমান খাঁর ‘পাকিস্তান’, হাবীবুল্লাহ বাহারের ‘পাকিস্তান’ তালেবুর রহমানের ‘পাকিস্তানবাদের ক্রমবিকাশ’ এবং ‘সর্বহারাদের পাকিস্তান’ ইত্যাদি গ্রন্থের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (সূত্র : আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, ধীরেন দত্তের প্রস্তাব ও আজাদ-এর সমর্থন, মোহাম্মদ, মাহফুজউল্লাহ, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪)। তবে এ কথা সত্য যে, ১৯৪৮ সালের আগে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কলমীযুদ্ধে এবং আন্দোলনের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে এবং সংগ্রামে তা রূপ লাভ করেনি। বস্তুত ১৯৪৮ সালেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন অতীতের ধারাক্রম হিসেবে ব্যাপকতা লাভ করে এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামে রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই নব পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি উত্থাপিত হয়। পাকিস্তান আমলে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দু’দফা আন্দোলন হয়েছিল। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের কথা। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। এ সময় দাক্ষিণাত্যের নিজাম শাসিত হায়দ্রাবাদের অন্তর্গত সেকেন্দ্রবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথির ভাষণে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ প্রস্তাবিত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে দারুণভাবে ওকালতি করে বলেন, ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সংহতি বজায় রাখার জন্য যেমন হিন্দি ভাষাকে সেই দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি এক রকমভাবে চূড়ান্ত হয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার লক্ষ্যে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টিও চূড়ান্ত করা অপরিহার্য।। কিন্তু ড. জিয়াউদ্দিন কৌশলগতভাবে একটা কথা এড়িয়ে গেছেন। সেটা হচ্ছে, যেখানে ভারতের সংখ্যাধিক্য লোকের মাতৃভাষা হিন্দি, সেখানে পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের (শতকরা ৫৬ ভাগ) মাতৃভাষা বাংলা। ড. জিয়াউদ্দিনের এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন কলকাতা থেকে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই কলকাতার দৈনিক আজাদ-এ ড. শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ নামে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিকে অগ্রগণ্য উল্লেখপূর্বক লিখেন, ‘যদি এরপরেও অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের কথা উঠে, শুধু তা হলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে।’ তার এই বক্তব্য সে আমলে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এদিকে পাকিস্তান অর্জিত হবার পর ১৯৪৭ সালে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সংগঠন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে সোচ্চার হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাশেমের সম্পাদনায় তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে। পুস্তিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ এবং ড. কাজী মোতাহের হোসেন রচিত ২টি নিবন্ধ সংকলিত হয। পুস্তিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিতিক আবুল মনসুর আহমদ এবং ড. কাজী মোতাহের হোসেন রচিত উর্দু ভাষার সমর্থনে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন বাবায়ে উর্দু, আব্দুল হক এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উর্দুর পক্ষে বক্তৃতা করেন কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙ্গালী শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। সম্মেলনে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার সুপারিশ করা হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে ২১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে পূর্ব বাংলার সমর্থনে জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামে আরো একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেন, ‘যাহারা বাংলা ভাষাকে ছাড়িয়ে কিংবা বাংলার স্কুল-কলেজের শিক্ষার মাধ্যমে (মিডিয়া) রূপে অথবা বাংলাদেশের আইন আদালতে ব্যবহার্য ভাষারূপে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করিতেছে, আমি তাহাদিগকে কান্ডজ্ঞানহীন পন্ডিতমূর্খ ভিন্ন আর কিছুই মনে করিতে পারি না।’ তবে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে পাকিস্তান গণপরিষদে কংগ্রেস দলীয় সদস্য কুমিল্লার প্রখ্যাত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ (একাত্তরের শহীদ) শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ এবং তা নাকচ হওয়ার ঘটনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের শ্রী দত্ত বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান গণপরিষদের আইনবিধি সংক্রান্ত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে (২৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ ১৯৪৮) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনবিধির ২৯নং উপধারা সংশোধন প্রয়াসে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে উর্দু ভাষার নাম সংযুক্ত করার সরকারি প্রস্তাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিম্নোক্ত সংশোধনটি উপস্থাপন করেন: ‘রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত? রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা সেই ভাষাই হওয়া উচিত, রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করে এবং … আমি মনে করি যে, বাংলা ভাষাই আমাদের রাষ্ট্রের লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা… যদি ২৯নং বিধিতে ইংরেজি ভাষা সম্মানজনক স্থান পেতে পারে-যদি পরিষদের কার্যাবলী উর্দু অথবা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে চলতে পারে তাহলে বাংলা, যা চার কোটি চল্লিশ লাখ লোকের ভাষা কেন সম্মানজনক স্থান পাবে না… কাজেই বাংলা ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এ ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষারূপে বিবেচনা করা উচিত, সুতরাং … আমি প্রস্তাব করি যে, ২৯নং বিধিতে ‘ইংরেজি’ শব্দটির পরে ‘অথবা বাংলা’ কথাটি যোগ করা হোক।’ (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খন্ড, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মার্চ ২০০৪, পৃষ্টা ৬১-৬৮) শ্রী দত্তের বক্তব্য ও দাবির মর্মার্থ হলো এই যে, পাকিস্তানের জনসংখ্যার মেজরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা দিলে চলবে না, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় শ্রী দত্তের বক্তব্য ও দাবির সপক্ষে অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের সপক্ষে গণপরিষদের কোন মুসলিম লীগ সদ্যই সমর্থয়ন করেননি এবং পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রী নওয়াবজাতা লিয়াকত আলী খানের প্রবল বিরোধিতার মুখে দত্তের প্রস্তাব গণপরিষদে নাকচ হয়ে যায়। দত্তের প্রস্তাবের বিরোধীতা করে লিয়াকত আলী পাকিস্তানের সংহতির নামে এমন অদ্ভূত বক্তব্যও রাখেন যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে উপমহাদেশের উর্দু ভাষাভাষী দশ কোটি মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে। তিনি বলেন, উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু। প্রকারান্তরে তিনি উর্দুকে মুসলিম জাতির ভাষা হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের সংহতির জন্য যে উর্দুকেই লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা অর্থাৎ যোগাযোগের ভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা রাখা উচিত, সে কথাও তিনি বলেন। লিয়াকত আলীর ভাষায়, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্রের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তথা সাধারণ যোগাযোগের ভাষা হওয়া উচিত একমাত্র উর্দু। প্রধানমন্ত্রী খানের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে গণপরিষদের কোন সদস্যই এমনকি পূর্ব পাকিস্তানী বাঙ্গলী সদস্যও উচ্চবাচ্য করেননি। এর কারণ সম্ভবত এই যে বাঙ্গালী রাজনীতিবিদ ও গণপরিষদের যারা সদস্য ছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন তথাকথিত ‘অভিজাত’ শ্রেণীর অন্তর্গত এবং তাদের বেশিরভাগই বাঙ্গালী হলেও মনোভাবের দিক থেকে ছিলেন ‘উর্দুপ্রেমিক’ এবং অনেকের গৃহেই ছিল উর্দু ভাষার প্রচলন। তবে গণপরিষদের বাঙ্গালী তথা পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যরা নীরবতা পালন করলেও খানের বক্তব্য এবং দত্তের প্রস্তাব নাকচ হওয়ার ঘটনা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল প্রতিক্রিয়া ও আলোড়নের সৃষ্টি করে এবং ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে নতুন গতিবেগ এবং সংগ্রামী চেতনার সঞ্চার করে। গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙ্গালী সদস্যরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন না করার সংবাদ ঢাকায় পৌঁছানোর পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা বাংলা ভাষার সমর্থনে ছাত্র ধর্মঘট ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এ সময উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতেও ছাত্ররা বাংলা ভাষার সমর্থনে সোচ্চার হয়। দত্তের প্রস্তাব যেমন একটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনা, তেমনি ঐ প্রস্তাবের সপক্ষে এবং প্রধানমন্ত্রী খানের বক্তব্যের বিরুদ্ধে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ প্রতিষ্ঠিত এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধও ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনা। আজাদে ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি (১৬ ফালগুন, ১৩৫৪) তারিখে ‘বাংলা ভাষার অপমান’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘… পাকিস্তানের গোড়া পত্তনের পূর্ব হইতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে, তাহা লইয়া বাদানুবাদ শুরু হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই বাদানুবাদের তীব্রতা বৃদ্ধি হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত মহলে বিশেষ করিয়া ছাত্র ও যুবক মহলে এই আশঙ্কা জাগে যে, পাকিস্তানে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত হইবে। কিন্তু গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বুদ্ধিমান মানুষ এই আশঙ্কাকে অমূলক মনে করিয়াছিলেন, কারণ পাক গণপরিষদের সদস্যগণের সংখ্যাগুরু অংশ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬১ ভাগেরও অধিক পূর্ব পাকিস্তানের এবং তাহাদের শতকরা ৯৯ জনেরও অধিক বাংলাভাষী। অধিকন্তু ইহা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু পাক গণপরিষদের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তানের আশাবাদী বিদগ্ধ সমাজের সকল স্বপ্ন ধূলিসাৎ হইতে চলিয়াছে। পাক গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করার দাবি উপেক্ষিত হওয়ার এই আশঙ্কাই বদ্ধমূল হইতেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাষা আজ পাকিস্তানের কোন স্থান পাইবে না এবং তাহা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি অগ্রগতি আশঙ্কাজনকভাবে ব্যাহত হইবে। শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাক গণপরিষদের বাংলা ভাষাকে পরিষদের অন্যান্য ভাষার সহিত সমানাধিকার দানের প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন। পাক ডমিনিয়নের মোট ৬ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা বলিয়া দাবি করার মধ্যে অযৌক্তিকতা কোথায়, তা আমাদের বোধগম্য হইতেছে না। পাক ডমিনিয়নের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁ শ্রীযুক্ত ধীরেন দত্তের প্রস্তাবের বিরোধিতা করিয়া যাইয়া যে উক্তি করিয়াছেন তাহাও আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করিয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, পাকিস্তান হইতেছে মোছলেম রাষ্ট্র এবং মুসলমানের জাতীয় ভাষা উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে। জনাব লিয়াকত আলী পাকিস্তানকে মোছলেম রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করিলেও কায়েদে আজম বহুবার তাহার ঘোষণায় ও বিবৃতিতে পাকিস্তানকে Seculare State (ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। সুতরাং জনাব লিয়াকত আলী কানের বক্তব্যের প্রথমাংশের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করিব না- কিন্তু শোষোক্ত অংশটি আমাদের হাস্যোদ্রেক করিয়াছে। উর্দু মুসলমানের জাতীয় ভাষা হওয়ার অধিকার করে কোথায় অর্জন করিল? মোগল শাসনের আমলে ভারতবর্ষে বিভিন্ন সংমিশ্রণে যে ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহাই উর্দু ভাষা এবং উর্দু ভাষার উন্নতির কালেও ফার্সি ছিল মোগল দরবারের এবং রাষ্ট্রের ভাষা। বর্তমানে জনাব লিয়াকত আলী যে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী সেই রাষ্ট্রের এক নগণ্যসংখ্যক লোক উর্দু ভাষাভাষী। সিন্ধু, সীমান্ত ও পাঞ্জাব উর্দুভাষী নহে। কাজেই পাকিস্তানের মুসলমান জনসাধারণের জাতীয় ভাষা উর্দু বলিয়া দাবির মধ্যে কোন যুক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। এই সব অযৌক্তিক তথ্যের ভিত্তিতে বাংলা ভাষার দাবিকে অগ্রাহ্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাবের উপরে নিষ্ঠুর আঘাত হানা হইয়াছে। দুই শত বৎসরের সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসন যে কাজ করিতে সাহস পায় নাই, আজাদ পাকিস্তান তাহা অনায়াসে করিয়া বসিল। বৃটিশ আমলে মুদ্রা, নোট ও মনি অর্ডার ফরমের উপর বাংলা সসম্মানে স্থান পাইয়াছে। কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের এইরূপ নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ আজাদ পাকিস্তানে সম্ভবপর হইবে তাহা কেহ কল্পনা করে নাই এবং ইহা সম্ভব হইল গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিকাংশের অক্ষমতার জন্য। গণপরিষদের সিদ্ধান্তে পূর্ব বাংলা আজ বিক্ষুব্ধ। ছাত্র, যুবক ও জনগণ তাহাদের ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষায় মর্মাহত। এই অবস্থায় গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণের এখন হইতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত যাহাতে বাংলা ভাষার অধিকতর অসম্মান তাহাদের বিষক্রিয়ায় না ঘটে। বাংলা ভাষার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান তাহজিব-তমদ্দুনে যে কামিয়াবী হাসিল করিয়াছে, তাহা সে হারাইতে চায় না; নতুন ভাষার জগদ্দল পাথর কাঁধে চাঁপাইয়া তাহার গতি ব্যাহত করার ক্ষীণতম প্রচেষ্টাও সে ভবিষ্যতে বরদাশত করিবে না। আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা কিা হইবে। তাহার আলোচনা এখানে না করিয়া আমরা বলিব, প্রাদেশিক শিক্ষার মাধ্যমে ও প্রাদেশিক দফতরের ভাষা বাংলা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের এই সর্বসম্মত দাবি পূরণ করার গুরুতর কর্তব্য গণপরিষদে তাহাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের পালন করিতে হইবে। এই দাবির বিরুদ্ধে তা যাঁহারা করিবেনা, তাঁহাদের পদত্যাগ করিয়া পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হওয়াই গণতন্ত্র সম্মত একমাত্র কর্তব্য।’ ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকায় ফজলুল হক হলে ছাত্রদের এক সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদা’ গঠন করা হয়। আহবায়ক মনোনীত হন সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র নেতা শামসুল আলম। বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ডেমোক্রেটিক লীগ ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বেশ ক’টি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা (বামপন্থী নেতা), তাজউদ্দিন আহমদ (একাত্তরের মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী), শহীদুল্লাহ কায়সার (একাত্তরের শহীদ), কাজী গোলাম মাহবুব (পরে এডভোকেট), কমরুদ্দিন আহমদ (১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট এর দফতর সম্পাদক ও পরবর্তীতে অনাহারে মৃত্যু), আনোয়ারা খাতুন (প্রাদেশিক পরিষদের এককালীন সদস্য), অধ্যাপক আবুল কাশেম (তমদ্দুন মজলিশ) এবং নঈমুদ্দিন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ছাড়াও অজিত গুহ, রণেশ দাশগুপ্ত, লিলি খান প্রমুখ। সভায় বাংলা ভাষার দাবীতে ১১ মার্চ সমগ্র দেশব্যাপী ধর্মঘট আহবান করা হয়। অচিরেই পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছাত্রদের উদ্যোগে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সরকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ১৪৪ ধারা জারি, গেফতার, ধরপাকড় প্রভৃতি সত্ত্বেও সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে হরতাল পালিত হওয়ায় সরকারী নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে আট দফা সংবলিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে বাংলা ভাষা প্রথমা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। চুক্তিপত্রের এক স্থানে বলা হয়, ‘এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে যে, প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসেবে ইংরেজী উঠে যাওয়ার পরই বাংলা তার স্থলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হবে। এ ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হবে বাংলা।’ উপরন্তু চুক্তির শর্ত মোতাবেক আটক ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হয়। ১৭ মার্চ দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত ‘মোবারকবাদ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘জনমতের জয় হইয়াছে। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ জাগিয়া উঠিয়েছিল পূর্ববঙ্গ গভর্নমেন্ট তা অকুণ্ঠচিত্তে মানিয়া লইয়াছেন। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে পূর্ব বাংলার ছাত্র-সমাজ প্রভূত শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন; আন্দোলনের কর্মসূচীতে আমরা বিশেষ করিয়া তাহাদিগকে অভিনন্দন জানাইতেছি।’ ১৯ মার্চ পাকিস্তানের স্রষ্টা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফর করেন। ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন যে, উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র এই জনসভাতেই ‘নো’ ‘নো’ ধ্বনি উচ্চারণ করে প্রতিবাদ জানায়। সেদিন এই প্রতিবাদ বিশাল জনসভার এক কোণায় সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথির ভাষণে যখন জিন্নাহ এ মর্মে বলেন যে, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনের পিছনে পঞ্চম বাহিনীর অস্তিত্ব রয়েছে’, তখনও ছাত্ররা কার্জন হলের অভ্যন্তরে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের শামসুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দিন আহমাদ, অলি আহাদ, অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় মোহাম্মদ তোয়াহা জিন্নাহর কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে আলোচনাকালে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরপরেই শাহ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান ও শামসুল হুদা চৌধুরীর নেতৃত্বে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আর একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ মর্মে বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা আন্দোলন যাঁরা করাচ্ছেন, তারা রাষ্ট্রের শত্রু। এঁদের অনেকেই মাত্র কিছুদিন আগে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত এশীয় যুব সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এঁদের গ্রুপ ফটো দৈনিক স্বাধীনতা ও আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। (সূত্র ঃ দমননীতির মোকাবেলায় আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, এম আর আর মুকুল, দৈনিক ইত্তেফাক ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৪) জিন্নাহর এই পূর্ববঙ্গ সফর মোটেই সফল হয়নি। তিনি বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মন মানসিকতা সম্পর্কে কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা সংগ্রহ করতে পারেনি। প্রসঙ্গত, একটা বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এ সময় রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু জিন্নাহর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি করাচীর অদূরে জিয়ারত নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন, ক্ষমতার পুনর্বণ্টনের ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষী নাজিমউদ্দিন হলেন নয়া গভর্নর জেনারেল। এর পাশাপাশি উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। এ বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের এক জনসভায় তিনি বলেন, ‘শত্রুপক্ষীয় চরদের রাষ্ট্র বিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে আমি সতর্কবাণী উচ্চারণ করছি।’ নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী খান পুনরায় পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক ছাত্র সভায় অত্যন্ত কৌশলে উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতি করেন। কিন্তু ‘ডাকসুর’ পক্ষ থেকে তাঁকে যে মানপত্র দেয়া হয়, তাতে সুস্পষ্টভাবে ২টি দাবি জানানো হয়। প্রথমটি হচ্ছে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকচক্র বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করল। তারা এ সময় একটা খসড়া মূলনীতি প্রণয়ন করে এবং এ মর্মে ঘোষণা দেয় যে, এই খসড়ার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হবে। এই খসড়ায় বলা হয় যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর সমর্থনে ২৭ ডিসেম্বর করাচীতে আয়োজিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়। বাঙ্গালী শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন। আলোচ্য সম্মেলন সংহতির লক্ষ্যে আরবী হরফে বাংলা ভাষার চালুর আবেদন করা হয়। ডা. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুঁৎমার্গের কোন স্থান নেই। ঘৃণা ঘৃণাকে জন্ম দেয়। গোঁড়ামি গোঁড়ামিকে জন্ম দেয়। একদল যেমন বাংলাকে সংস্কৃতিঘেঁষা করতে চেয়েছে, তেমনি আরেকদল বাংলাকে আরবী-ফারসীঘেঁষা করতে উদ্যত হয়েছে। একদল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে বলি দিতে আর এক দল চাচ্ছে জবেহ করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া, আর অন্যদিকে কসাইয়ের ছুড়ি।’ ১৯৪৯ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। এ বছরে ২৩ জুন পুরানো ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে এই ব্যাপক ভিত্তিক বিরোধী দল গঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন মাওলানা ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন যথাক্রমে শামসুল হক ও কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী মুসলিম লীগ এগিয়ে এলো বাংলা ভাষা এবং স্বায়ত্বশাসন দাবীর সমর্থনে। ফলে পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যাপ্তি লাভ করলো। প্রসঙ্গত একটা কথা বলতেই হয় যে, পুরানা ঢাকার রোজ গার্ডেন-এর মালিক ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক হুমাউন বশীর। তিনি ছিলেন উদারপন্থী চরিত্রের অধিকারী। তাই বশির অত্যন্ত গোপনে মওলানা ভাসানীকে তাঁর বাগানবাড়ি রোজ গার্ডেন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারটা ছিল গোয়েন্দা বিভাগের ধারণার বাইরে। যখন তারা খবর পেল, তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন এবং অফিস বেয়ারার পদে নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। বাকী শুধু ওয়ার্কিং কমিটির নাম ঘোষণা। ২৩ জুন অপরাহ্নে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ার আগেই নেতৃবৃন্দ স্থান ত্যাগ করেন। নেতৃবন্দ পরদিন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ওসমান সাহেবের বাঘা ‘বায়তুল আমানে’ জমায়েত হন। এখানেই ৭ জন অফিস বেয়ারাসহ ৪০ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটির ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ৪টি বছর ছিল পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীদের জন্য খুবই বিপদসংকুল সময়কাল। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় একটা ভুখা মিছিলের আয়োজন করা হলে ওই মিছিল থেকেই ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। নাজিরা বাজার এলাকা কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে মুক্তি দেয়া হলেও শেখ মুজিবকে কারাগারেই আটক রাখা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় শেখ মুজিব ছিলেন বিপজ্জনক ব্যক্তি। ১৯৫০ সালে জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনে কুঠারাঘাত করার লক্ষ্যে উভয় বঙ্গে সংগঠিত হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গা প্রশমিত হওয়ার স্বল্প দিনের ব্যবধানে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরস্ত্র রাজবন্দীদের ওপর গুলিবর্ষণে ৭ জন নিহত এবং ৩১ জন আহত হয়। এ বছরেই খুলনা জেলে কমরেড বিষ্ণু বৈরাগীকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং যশোর জেলে কমরেড মোজাম্মেলকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আত্মাহুতি দেন অনশনরত রাজবন্দী কমরেড শিবেন রায় ও কমরেড ফণীগুহ। জোর করে নল দিয়ে খাওয়ার সময় তরল খাদ্য ফুসফুসে চলে যাওয়ার দরুন এদের মৃত্যু হয়। মুসলিম লীগ সরকারের ভয়াবহ দমননীতির জন্য কোনো সংগঠন সাহস করে এসব হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনি। কম্যুনিষ্ট পার্টি এ সময় বেআইনী ঘোষিত হয়নি; অথচ এদের নেতৃবৃন্দের তখন পলাতকের জীবন। ১৯৫১ সালের ২৮ মার্চ ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীবক্ষে ভাসমান নৌকায় জন্ম হয় প্রগতিশীল যুব প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের। ঢাকা শহরে জারিকৃত ১৪৪ ধারা বিধিনিষেধ ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াবার জন্য সেদিন যুবলীগের সম্মেলন বুড়ীগঙ্গা নদীবক্ষে করতে হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এই যুবলীগের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় বক্তৃতাদানরত অবস্থায় পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খসড়া মূলনীতি আর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি আবারো চাপা পড়ে যায়। এবার প্রধানমন্ত্রী হন পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ দলীয় উর্দুভাষী নেতা খাজা নাজিমউদ্দিন। তিনিও একই সমস্যার সম্মুখীন হন। সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রভাষার বিষয়টির ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী ঢাকায় পল্টন ময়দানে আয়োজিত মুসলিম লীগের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নাজিম আবারো উচ্চারণ করেন ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ এরই ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গে শুরু হলো দ্বিতীয় দফায় বাংলা ভাষা আন্দোলন। এর চরম পর্যায় হচ্ছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীকে ‘শহীদ দিবসস্বরূপে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত করেন। কর্মপরিষদের পক্ষে আহবায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘…অতএব আসন্ন ২১ ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করিবার জন্য আমি পাকিস্তানের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী জনতার নিকট আবেদন জানাইতেছি। দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনপূর্বক অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তির দাবীকে বজ্রকঠিন কণ্ঠে ঘোষণা করিবার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানাইতেছি। দেশের সকল দল ও সংগঠনের প্রতি আমার আবেদন-আপনারা সর্বত্র সংযুক্ত ফ্রন্ট মারফত অটুট ঐক্যের মধ্যদিয়া জনতার সুদৃঢ় সংহতি গড়িয়া তুলুন। শহীদ দিবসকে সার্থক ও জয়যুক্ত করিয়া তুলুন।’ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনের আহবান জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রোযা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির আগে কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক মুক্তি পান। শামসুল হক মুক্তি পান ১৩ ফেব্রুয়ারি, যদিও সে সংবাদ সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে ১৫ মার্চ। মওলানা তর্কবাগীশের ছেলে নূরুল আলম সিলেট জেল থেকে মুক্তি পান ১৭ ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে মওলানা ভাসানী, আব্দুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, ওসমান আলী, অলি আহাদসহ সকল রাজবন্দী একদিনের জন্য অনশন করেন এবং খোরাকির টাকা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কাছে প্রেরণ করতে অনুরোধ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির ছাত্রনেতাদের সেক্রেটারিয়েটে ডেকে পাঠানো হয়। তখন পূর্ব বাংলার চীপ সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইসহাক, আই.জি. দোহা আর জি.ও.সি. মেজর জেনারেল আদম। সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে পাঠানো হয় আব্দুস সামাদ, মোহাম্মদ সুলতান, আখতারউদ্দিন, শামসুল হক, জিল্লুর রহমান, ইব্রাহিম আতা ও গাজীউল হককে। হয়তো তাঁদের গ্রেফতার করা হবে এই আশঙ্কায় তারা একটি কমিটি মনোনয়ন করে যান, তার কয়েকজন সদস্য খোন্দকার গোলাম মোস্তফা, ইশতিয়াক আহমদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান, আনোয়ারুল আজিম প্রমুখ। আলোচনার সময় আইজি ও জিওসি খারাপ ব্যবহার করেন। তর্কাতর্কি চলে। ইব্রাহিম তাহা এক সময় জেনারেল আদমকে বলেন, ‘জানতে চান কেন আমরা আন্দোলন করি? জেনে খুশী হবেন যে আপনার কুকুরটি একদিনে যতটা মাংস খায় আমরা সপ্তাহেও তা খেতে পাই না।’ আদম স্বভাবতই খুব চটে যান। শান্ত, ভদ্র চীপ সেক্রেটারির হস্তক্ষেপে বৈঠকের নষ্ট পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। তিনি বলেন, ১৪৪ ধারা জারি করার বা মিছিলে বাধা দেয়ার ইচ্ছা সরকারের নেই, তবে ছাত্ররা যেন বিশৃক্মখলা সৃষ্টি না করে, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি না করে। উত্তরে গাজীউল হক বলেন, ‘মিছিলের আগে পিছে একশ’ গজের মধ্যে যদি পুলিশ না থাকে তাহলে মিছিল শান্তিপূর্ণ হবে। দোহা এই প্রস্তাবে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু চীপ সেক্রেটারি তা মেনে নেন। ইব্রাহিম আতা তখন শহীদ স্মরণে তাঁর বুকে একটি কালো ব্যাজ পরিয়ে দেন। মোঃ ইসহাস হাসতে হাসতে সেটি পড়ে নেন। ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ২টায় ফজলুল হক হলে ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকদের বৈঠক হয়। সেখানে রেল ধর্মঘট করানোর সিদ্ধান্ত হয়। রাত সাড়ে তিনটায় তাজুদ্দিন ও গাজীউল হক ঢাকার রেল ওয়ার্কশপে পিকেটিং করার জন্য চলে যান। ২০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সজল চোখে মোনাজাত করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শনিবার উদযাপিত হয় শহীদ দিবস। রাজধানী ঢাকার প্রত্যেকটি দোকানপাট, বাস, রিকশা, গাড়িঘোড়া, বাজার বন্ধ ছিল। স্টেট ব্যাংক, ইম্পিরিয়াল ব্যাংক, লয়েড ব্যাংকসহ সকল ব্যাংক হরতাল পালন করে। রেল, সিনেমা বন্ধ থাকে। হাজার হাজার ছাত্র, কর্মী গম্ভীর পরিবেশে কালো ব্যাজ ধারণ করে রাস্তায় টহল প্রদান করে। করাচিস্থ ফরাসি ও মার্কিন দূতাবাস থেকে বিশেষ প্রতিনিধি ঢাকায় প্রেরিত হয়েছিল। এদিন ঢাকাস্থ বিদেশী দূতাবাসগুলোকে বিশেষ সক্রিয় মনে হচ্ছিল। ব্রিটিশ ও মার্কিন কূটনীতিক সার্ভিসের লোকদের সারাদিন ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এমনকি আরমানিটোলার জনসভায়ও তারা উপস্থিত ছিলেন। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা দেখছেন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী একটানা বিক্ষোভ-ক্ষমতাসীন মুষ্টিমেয় লোক একদিকে, গোটা দেশ একদিকে। শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ দিবস উদযাপনের জন্য ২৫ নম্বর সোয়ারিঘাটে কর্মপরিষদের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ৯৪ নং নওয়াবপুর রোড, ১ নং মৌলভীবাজার, জগন্নাথ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি স্থানেও কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুস সামাদ এবং আরো অনেকে সাইকেলে করে গোটা শহর টহল দিয়ে বেড়ান। ছাত্র-জনতার মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া দেখে শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানকারীরা অভিভূত হয়ে পড়েন। শহীদদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে গোটা শহর যেন চরম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অপূর্ব প্রেরণা। স্কুল-কলেজ বন্ধ। ভোরে ছাত্র-জনতা যখন দলে দলে ‘প্রভাত-ফেরী’ করে শহীদদের মাজারে পু অর্পণ করতে যাচ্ছিলেন তখন শহরে করুণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সকলের চোখে পানি, কিন্তু চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে দৃঢ় প্রত্যয়। সকাল ৫টা থেকে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্র ও মহল্লার মানুষ আজিমপুর গোরস্তানে গিয়ে শহীদের সমাধিতে মালা দেন। কর্মীরা জানতেন, দেশবাসী শহীদদের ভোলেনি, তাদের স্মৃতি প্রত্যেক নরনারী, ছাত্রছাত্রীর হৃদয় অধিকার করে বসে আছে। এই জনতাকে সুসংহত ও শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করাই ছিল কর্মীদের দায়িত্ব। জনতা তাতে দিয়েছিলেন অভূতপূর্ব সক্রিয় সাড়া। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ দিবস বিরাট সাফল্য লাভ করায় দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির সুনিশ্চিত জয় হলো, স্বৈরাচারীদের কবজা শিথিল হয়। সকাল ১০টা-১২ টার মধ্যে বিভিন্ন রাস্তা অতিক্রম করে বহু খন্ড মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়। সেখান থেকে বেলা ১টায় ৩০ হাজারের বেশি ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মিছিল বের হয়। সকলে কালো ব্যাজ ধারণ করে। মেডিকেল কলেজের সামনে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও মাগফিরাত প্রার্থনা করা হয়। তারপর মিছিল পরিষদ-গৃহের পাশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে দিয়ে হাইকোর্ট, ইডেন বিল্ডিংয়ের উত্তর ও পূর্ব দিয়ে, নওয়াবপুর, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, চক, জেল গেট, বংশাল ও মাহুতটুলির হয়ে আরমানিটোলা ময়দানে বেলা ৩টায় উপস্থিত হয়। বিভিন্ন জায়গার মেয়েরা বাড়ির ছাদ থেকে মিছিলের উপর পু বৃষ্টি করে মিছিলের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন ও ভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা মিছিলের সামনে থেকে শৃক্মখলার দিকে নজর রাখেন। স্বেচ্ছাসেবকরা মিছিল নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। পাকিস্তান এ্যাম্বুলেন্স কোরের স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী মিছিলে আর জনসভায় থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদির বিশেষ ব্যবস্থা করেন। এরূপ বিরাট অথচ সুষ্ঠু শৃক্মখল মিছিল ঢাকায় আর আগে হয়নি। সরকারের তরফ থেকে উস্কানি না দেয়া হলে জনতা ও ছাত্র যে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা ও সভা পরিচালনা করতে পারে এবার তা প্রমাণ হয়। ক্ষমতার দম্ভ ও প্রতাপ দেখাবার ইচ্ছা এবার ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারীদের ছিল না। তারা পূর্বদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেন, তাতে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি তিরোহিত হয়। সকাল থেকে শত-শত স্বেচ্ছাসেবক শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে কোনো গন্ডগোল না হয়। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেরাও অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতা ও শৃক্মখলার পরিচয় দিয়েছে। পূর্ব পাক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. ওয়াদুদ স্বেচ্ছাসেবকদের অধিনায়কের কাজ করেন। মিছিলের পর আর্মানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের চারদিকের রাস্তা ও ঘরবাড়ির ছাদ লোকে ভরে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরপরই জনতার এইসব শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠেঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। শহীদ স্মৃতি অমর হোক। জালেম শাহী লীগ ধ্বংস হোক! গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। লীগ শাহীর দালাল মর্নিং নিউজ ধ্বংস হোক! ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের আহবায়ক আতাউর রহমান খান সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, সৈয়দ আবদুর রহিম, কাজী গোলাম মাহবুব, আব্দুস সামাদ, মাহমুদ আলী, সোলায়মান খান, হেদায়েতুল ইসলাম, এম. এ. ওয়াদুদ, গাজীউল হক, মতিয়ুর রহমান, আখতারুদ্দিন আহমদ, মিস হালিমা খাতুন, ইব্রাহিম আতা, হেদায়েতুল ইসলাম সেলিম, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর আলী বক্তৃতা করেন। যুগ্ম আহবায়ক জমিরুদ্দিন আহমদ কর্তৃক উত্থাপিত যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তা হলো: (১) সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা কর্মপরিষদ কর্তৃক আহূত এই জনসভা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করার গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে বরকত-সালাম-জববার-রফিক-শফিক প্রমুখ যে সমস্ত বীর শহীদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও দেশীয় একচেটিয়া বেনিয়াদের তল্পিবাহক ফ্যাসিস্ট লীগ সরকারের মিলিটারী ও পুলিশের গুলীতে প্রাণ দান করেছেন তাদের পবিত্র অমর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করছে। এই প্রসঙ্গে এই জনসভা এই পবিত্র শপথ গ্রহণ করছে যে, শহীদদের রক্তক্ষরা মাতৃভাষার এই গণতান্ত্রিক দাবি তারা যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হউক হাসিল করবে, (২) এই সভা গভীর উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করছে যে, বরকত-জববার-শফিক-সালাম-রফিক প্রমুখ দেশপ্রেমিকদের হত্যাকারী লীগ সরকার জনমতের চাপে বাংলাভাষার দাবি স্বীকার করেও এই মহান সংগ্রামের বীর নেতা ও কর্মীদের অত্যন্ত অন্যায়ভাবে জেলে আটক রেখেছে, আর শুধু তাই নয়, ফ্যাসিস্ট জেল-জুলুম, চালিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতেছে। এই সভা জালিম লীগশাহীর এই পুলিশী সন্ত্রাসের তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছে এবং বিনা বিচারে আটক সকল রাজবন্দীদের অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি দাবি করছে, (৩) এই সভা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, আমাদের মাতৃভূমিতে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের শোষণ কায়েম রাখার জন্য গণবিরোধী লীগ সরকার তথাকথিত নিরাপত্তা আইনের আশু প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছে। মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষের ভাষার দাবি নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলছে এই সভা তার তীব্র নিন্দা করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই পবিত্র দিনে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, ভাষার দাবি তথা সমস্ত জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে পাকিস্তানের জনসাধারণ সংগ্রাম করে যাবে, (৪) গণস্বার্থবিরোধী মুসলিম লীগ সরকার রুগ্ন জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে মরণাপন্ন অবস্থায় ঢাকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হতে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আবার স্থানান্তরিত করেছে। জনসাধারণের এই সভা এর তীব্র নিন্দা করছে এবং অবিলম্বে মওলানা ভাসানীর বিনাশর্তে মুক্তি দাবি করছে। মাহমুদ আলী সম্পাদিত ঢাকা ও সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলালের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। কালো রেখায় বেষ্টিত সম্পাদকীয়টি মুদ্রিত হয় প্রথম পৃষ্ঠায়, তার বৃহৎ টাইপের শিরোনাম ছিল, ‘ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের সংগ্রামী শপথ।’ বলা হয়, ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত ঘটনা যেইদিন সংগঠিত হয়, সেই ২১ ফেব্রুয়ারি আবার সমাগত। ঠিক এক বছর পূর্বে ঢাকার রাজপথে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার উপর মুসলিম লীগ সরকারের ফৌজের গুলীবর্ষণে মাতৃভাষার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামের বীর সেনা রফিক, সালাম, জববার, সফিকুর (হবে শফিউর) রহমান প্রমুখ কয়েকজন দেশপ্রেমিক তরুণ আত্মবলী দেন। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত নাজিম-নূরুলচক্র জনতার জাগ্রত সংগ্রামী চেতনা ও ইস্পাত কঠিন সংহতিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হইয়া তাহার পুলিশ ও সামরিক বাহিনী লেলাইয়া দেন। ঢাকার রাজপথ সেইদিন শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হইয়া উঠে। আর সারা দেশের আকাশ-বাতাস, মাঠ-ঘাট, শহর-বন্দর ধূমায়িত হইয়া উঠে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে জনতার সীমাহীন ঘৃণা ও ক্রোধবহ্নি। প্রতি বছরই এই একুশে ফেব্রুয়ারি আসিবে আবার শেষ হইয়া যাইবে। কিন্তু যে ঘৃণা আর ক্রোধের আগুন দেশবাসীর হৃদয়ে জ্বলিয়াছে, তাহার শেষ নাই-তাহা বারবার এমনিভাবে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিবে। ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষার পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মাহুতি দিয়া শহীদগণ যে রক্তোজ্জ্বল ঐতিহ্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা জাতির স্বাধীনতা, শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রত্যেকটি লড়াইকে সুনিশ্চিতভাবে অনুপ্রাণিত করিবে। তাই আমরাও দেশবাসীর সহিত সমন্বরে ঘোষণা করিতেছি : একুশে ফেব্রুয়ারি চিরস্মরণীয় হউক-শহীদ স্মৃতি অমর হউক। আর জানাই আমাদের অন্তরের অভিনন্দন সেই বীর শহীদ মুক্তিসেনানীদের…… শহীদ দিবসকে দেশবাসী শুধুমাত্র একটি দিবস হিসাবেই পালন করিয়া ক্ষান্ত হইবেন না, ইহা আমরা বিশ্বাস করি …. ভাষার আন্দোলন শুধু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইহা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া ও কোটিপতিদের প্রতিনিধি মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার কবল হইতে জাতির স্বাধীনতা, শান্তি ও গণতন্ত্রকে রক্ষার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক অচ্ছেদ্য অংশ …।’ প্রথম পৃষ্ঠায় আরো মুদ্রিত হয় দু’টি তালিকা : ‘যারা শহীদ হয়েছেন’ এবং ‘যারা আজও কারাগারে’। ‘নওবেলাল’র এই সংখ্যার প্রধান প্রবন্ধটি হচ্ছে আলী আশরাফ লিখিত ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা।’ এই প্রবন্ধটি ঢাকার ‘সচিত্র রম্য সাপ্তাহিক ‘পূর্ব বাংলা’র ‘অমর শহীদ স্মৃতি সংখ্যাতেও’ প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি নব পর্যায়, ১ বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা। অবশ্য প্রবন্ধটি এই সংখ্যায় শেষ হয়নি, ৬ মার্চের পরবর্তী সংখ্যায় শেষ হয়। প্রবন্ধটিতে বলা হয়- ‘২১শে ফেব্রুয়ারি ঘুরে এসেছে। এক বছর পর ঘুরে এসেছে আবার সেই পবিত্র দিন-যেদিন নিজ মাতৃভূমির ভাষার মর্যাদা ও অধিকারের জন্য পূর্ববঙ্গের নওজোয়ানরা তথা সারা জনতা- নিজেদের জান-মাল কোরবানী দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের এই অতুলনীয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ অকস্মাৎ এসে হাজির হয়নি। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরই পূর্ববঙ্গে এ সংগ্রাম শুরু হয়। শুধু তাই নয়। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল যুগ যুগ আগে অবিভক্ত ভারতে। অবিভক্ত ভারতে রাষ্ট্রের কাজ-কর্ম কোন্ ভাষায় চলবে, বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণ নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভের অধিকার পাবে কিনা, তারা নিজ নিজ বাসভূমির (প্রদেশের) রাজকার্য নিজ নিজ ভাষায় পরিচালনা করার অধিকার পাবে কিনা প্রভৃতি প্রশ্ন বহু বছর আগেই উঠেছিল। বস্তুতঃ অবিভক্ত ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যতই প্রসার লাভ করেছিল, জনগণের ভেতর গণতান্ত্রিক চেতনার যতই বিকাশ হচ্ছিল, বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের ভেতর নিজ নিজ জাতীয় অধিকারবোধও তত বেড়ে উঠেছিল। অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতি একথা উপলব্ধি করেছিল যে, নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষা লাভ করা ও রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা করার অধিকার তাদের জাতীয় মুক্তির অপরিহার্য শর্তা। তাই জাতীয় মুক্তির অন্যতম মৌলিক অধিকার রূপেই বিভিন্ন ভাষার দাবি অবিভক্ত ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ জোরের সঙ্গে দেখা দিয়েছিল। তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠী জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল, ইংরেজিই হবে একমাত্র ‘‘রাষ্ট্রভাষা’’। ‘‘রাষ্ট্রভাষা’’ কথাটাও স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফলরূপেই প্রচলিত হয়ে আসছে। অবিভক্ত ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতনের পূর্বে রাষ্ট্র ব্যবস্থা যখন ছিল সামন্তযুগীয় রাজতন্ত্র, যখন শাসকগোষ্ঠী দেশের জনসাধারণ থেকে আলাদা এবং উচ্চতর জীব হিসেবে একটা বিশেষ মর্যাদা ও অধিকারসম্পন্ন শ্রেণী (Privileged Class) বলে নিজেদের জাহির করতো, তখন রাজদরবারে ব্যবহৃত হতো একটি বিশেষ (Court Language) যে ভাষা অধিকাংশ জনসাধারণের ভাষা হতে পৃথক ছিল। যেমন নবাবী আমলে এক সময়ে বাংলাদেশের রাজ-দরবারে ব্যবহৃত হত ফার্সী। কিন্তু এ থেকে এ ধারণা করার কোনো কারণ নেই যে, ফার্সী ভাষাটা একটি বিশিষ্ট শ্রেণীর ভাষা কোনো ভাষাই কোনো বিশিষ্ট শ্রেণীর ভাষা নয়। এক একটি ভাষা শ্রেণী নির্বিশেষে কোনো এক একটি জাতির ভাষা। যেমন ফার্সী ভাষা নবাবী আমলে বাংলাদেশের রাজদরবারের ভাষা হলেও আসলে এ ভাষা হলো পারস্য দেশের। ভাষার ক্ষেত্রে এ স্বেচ্ছারিতা দেশ বিভাগের পরও শেষ হলো না। দেশ বিভাগের পর রাষ্ট্রক্ষমতা লীগ নেতাদের হাতে ‘‘হস্তান্তর’’ হওয়ার মধ্য দিয়ে যেমন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসন পরোক্ষ শাসনে পরিণত হলো, ঠিক তেমনি ভাষার ক্ষেত্রে আগের স্বেচ্ছাচারিতা ভোল বদলিয়ে নতুন স্বেচ্ছাচারিতার রূপ গ্রহণ করলো। লীগ নেতারা ঘোষণা করলেন-‘‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’’ স্বৈরাচারী লীগ শাসন পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষাভাষী জনগণের ভাষাগুলোকেও উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রের বিশেষ ভাষার মর্যাদা দিতে চাইলেন। এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই অতীতের সেই ভাষার লড়াই আবার জেগে উঠলো। নতুনভাবে নতুন শক্তিতে। সে লড়াই একটা বিশেষ গৌরবময় রূপ ধারণ করেছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু বিভাগোত্তরকালের ইতিহাসেই নয়, এ পবিত্র দিনটি আমাদের দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমস্ত ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ২১শে ফেব্রুয়ারির সে গৌরবময় গণজাগরণের সামনে স্বৈরাচারী লীগ শাসনকে সাময়িকভাবে হলেও পিছু হটতে হয়েছে। তার প্রমাণ হলো যে, শাসনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসকচক্রের এখন এ সাহস নেই যে, প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারে ‘‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’’ তাই তারা চুপ করে আছে। এটা তাদের দুর্বলতার লক্ষণ। তবে তাদের এ নীরবতার আর একটি দিক আছে। প্রথমতঃ এ নীরবতার ফাঁকে এখনও কার্যতঃ ইংরেজি ‘‘রাষ্ট্রভাষারূপে’’ চালু থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত ঃ স্কুল-কলেজে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার কার্য পরিচালনায় উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে শাসকচক্র পেছনের দরজা দিয়ে উর্দু চাপাতে চাইছে। তৃতীয়ত ঃ শাসকচক্র অপেক্ষা করছে সুযোগের সন্ধানে। সুযোগমত তারা আবার নিজের স্বৈরাচারী রূপ নিয়ে প্রকাশ্য আসরে নেমে আসবে। তাই শাসকচক্রের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠী হলো এ দেশের সামন্তবাদী ভূস্বামী ও মুষ্টিমেয় বড় ব্যবসায়ীর মুখপাত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষক। সামন্তবাদী ভূ-স্বামীরা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই হলো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুশমন। এরা কোনো ভাষাভাষী জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভাষার অধিকার প্রভৃতি কোনো অধিকারই স্বীকার করতে চায় না। সে জন্যই লীগ শাসনে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের রুটি-রুজির মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন পর্যুদস্ত হচ্ছে, তেমনি ভাষার অধিকারও পদদলিত হচ্ছে। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ শাসকচক্র প্রধানতঃ উর্দুভাষী। সে জন্য তারা অন্যান্য ভাষাকে পদদলিত করে উর্দুকেই ‘‘রাষ্ট্রভাষা’’ করতে চায়। দ্বিতীয়ত ঃ যেহেতু এরা সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর বৃটিশ ও মার্কিন প্রভাব রয়েছে তাই এরা আরও ২০ বছর রাষ্ট্রভাষারূপে ইংরেজিকেও চালু রাখার জন্য ওকালতি করছে। অর্থাৎ উর্দুকে ‘‘রাষ্ট্রভাষা’’ করেও নানা যুক্তি-ওজর দেখিয়ে তার সঙ্গে ইংরেজিকেও ‘‘রাষ্ট্রভাষার’’ মর্যাদা দিয়ে রাখা এই স্বৈরাচারী শাসকচক্রের অভিসন্ধি। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রকার্যে জনগণকে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার জন্যও জনগণকে অশিক্ষিত মূর্খ রেখে তাদের উপর শোষণ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই স্বৈরাচারী পথ গ্রহণ করেছে। মুসলিম লীগ শাসকচক্রের আসল শ্রেণীরূপ ও তার অভিসন্ধি বুঝে তার বিরুদ্ধে আমাদের সকলের ভাষার মর্যাদার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *