‘ক্লাসিক’ সেঞ্চুরিতে মুশফিকের অসাধারন জবাব

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল খুবই খারাপভাবে। দুই টেস্ট সিরিজেই শোচনীয়ভাবে হেরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু সেই পরাজয়কে ছাপিয়ে ওঠে অধিনায়ক হিসেবে ব্যর্থতা। কেন টসে জিতে ব্যাট করতে নামলেন না, সেটাই প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। বোর্ড প্রধান পর্যন্ত প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেন। তাকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তার অবস্থানে ছিলেন অনড়।
অপেক্ষা করছিলেন কিছু একটা করার এবং সেটা ব্যাট হাতে। সেটাই করলেন ৩০ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম একদিনের ম্যাচেই তিনি দেখিয়ে দিলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। আরো অনেক কিছু দেয়ার আছে তার। আজ মুশফিক ১১০ রান করে অপরাজিত থাকেন। তিনি ১১৬ বলে ১১টি চার আর ২টি ছক্কা সহযোগে এই স্কোর করেন। তার কয়েকটি পার্টনারশিপও দলকে চ্যালেঞ্জিং স্কোরে নিয়ে গেছে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা তার পঞ্চম সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরির পর সিজদায় অবনত হয়ে পড়েন তিনি। কৃতিজ্ঞতা প্রকাশ করেন পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে।
যেভাবে উত্থান
নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রমাণস্বরূপ খ্যাতি যেমন পেয়েছেন ঠিক তেমনি একজন নির্ভরযোগ্য মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেও দলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সর্বোকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে যুক্ত হয়েছে মুশফিকের নাম।
বিকেএসপিতে বন্ধুরা যখন দেখত ভবিষ্যতের স্বপ্ন, মুশফিকের তখন টেস্ট অভিষেক। অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলা ৩ টেস্ট আর ১৮ একদিনের ম্যাচে যথাক্রমে ৩১ ও ৩৫ গড়ে রান করে দ্যুতি ছড়ানো মুশফিকুর রহীম ডাক পান ২০০৫-এর বাংলাদেশ দলে।
মাত্র ১৬ বছর ২৬৭ দিনে লর্ডস গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামেন। মিডল অর্ডারে শেষ বছরে বাংলাদেশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতিয়েছেন।
অপরিচিত কন্ডিশনে আর বাউন্সী ট্র‍্যাকে অনভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে শুধু মুশফিকের জন্য না , পুরো বাংলাদেশ দলের জন্যই সফরটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। তার উপর খালেদ মাসুদ পাইলটের জায়গায় উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া ১৬ বছর বয়সী মুশি কতটুকু কি করতে পারবেন ইংল্যান্ডে, মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সংশয় তো ছিলোই। কিন্তু সকলের মনের সব সংশয় দূর করে দিলেন।
১৯৮৮ সালের ৯ মে বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করা মুশফিক জাতীয় দলের হয়ে প্রস্তুতি ম্যাচে এসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের হয়ে খেললেন ৬৩ ও ১১৫ রানের দারুণ দুটি ইনিংস।
সুযোগ পেয়ে গেলেন সেরা একাদশে। ২৬শে মে ২০০৫, লর্ডসের সবুজ ঘাসে অভিষিক্ত হয়ে রেকর্ড গড়লেন ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মুশফিকুর রহীম।
খেললেন মুশফিক, গর্বিত করলেন তার মা বাবাকে। গর্বিত করলেন বগুড়াবাসীকে। ১৯ রান করে অভিষেকটা তেমন স্মরণীয় করতে না পারলেও ১০৮ রানে অলআউট হওয়া বাংলাদেশ দলের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় ব্যাটসম্যান যিনি কিনা দুই অঙ্কের ঘরে পৌছতে পেরেছিলেন। কিন্তু মুশফিকের কি দূর্ভাগ্য, ইনজুরিতে পড়ে পুরো সিরিজের জন্যই চলে গেলেন মাঠের বাইরে। ঘরে বসে মা রহিমা খাতুনের চোখের পানিতে ভিজে যায়।
খালেদ মাসুদ পাইলট-এর পরে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সফল উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান নিসন্দেহে মুশফিকুর রহীম। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক। সাকিব আল হাসানের স্থলভিষিক্ত মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সফল অধিনায়কও! ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ২০১১ সালে একমাত্র টি-২০ ম্যাচে শেষ বলে ৬ দিয়ে ম্যাচ জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন এই মুশফিক। আবার এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ২৫ বলে ৪৬ রানের ইনিংস। ২০১২ সালে আবার ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সাহসী ব্যাটিং দিয়ে ৩-২ এ সিরিজ জয় ও সিরিজ সেরা নির্বাচন।
আগষ্ট ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে টেস্ট ও একদিনের সিরিজ হারের সাথে সাথে ড্রেসিং রুমে অশোভন আচরন ও কোচের সাথে অযাচিত কথাবার্তার কারণে অধিনায়ক সাকিবকে ও তার সহঅধিনায়ক তামিমকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময়ে অস্টেলিয়ার কোচ স্টুয়ার্ট ল-এর সাথে আলোচনা করে মুশফিকুর রহিমকে অধিনায়ক ও তার ডেপুটি হিসেবে মাহমুদুল্লাহকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম ম্যাচেই ঘরের মাঠে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ২৬ বলে ৪১ রানের ইনিংসে টি-২০ তে জয় পায় তবে টেস্ট সিরিজ ২-০ তে ও ওয়ানডে সিরিজ ২-১ এ হেরে যায়।
এর পরের গল্পটা পরিশ্রম আর এগিয়ে যাওয়ার গল্প। কীভাবে কঠোর পরিশ্রম একটা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ যেন মুশফিকুর রহীম। করলেন ভারতের বিপক্ষে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে পেলেন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব। দলকে নিয়ে গেলেন এশিয়া কাপের ফাইনালে, জিতলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ, নিউজিল্যান্ড সিরিজ।
শ্রীলংকার মাটিতে করলেন ২০০ রান। ঘরোয়া লীগ বলেন কিংবা জাতীয় দল দুই জায়গাতেই সমানভাবে পারফর্ম করে যেতে লাগলেন।
একনজরে মুশফিক
পুরো নাম : মোহাম্মদ মুশফিকুর রহিম
জন্মস্থান : বগুড়া
জন্ম তারিখ : ৯ মে, ১৯৮৭
ব্যাটিংস্টাইল : ডানহাতি
টেস্ট অভিষেক : প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ২০০৫
ওয়ানডে অভিষেক : প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, ২০০৬।
সৌজণ্যে – দৈনিক নয়া দিগন্ত

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *