রোহিঙ্গা: বিপন্ন মানবতার অপর নাম

লীনা পারভীন::
২৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিদিনের প্রধান খবর হচ্ছে দলে দলে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ। পত্রিকার পাতায় এক একটি প্রতিবেদন পড়ি আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্ষুধার্ত আর জীবন ভয়ে পালিয়ে আসা এক দল মানুষের চেহারা।
রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই হচ্ছে নারী ও শিশু। এমনি একটি গ্রুপের বর্ণনা পড়লাম পত্রিকার পাতায়। ১১ জনের দুটি পরিবার এসেছে পালিয়ে। সেখানে ২ জন মহিলা ছাড়া বাকি সবাই শিশু। দুটি পরিবারেরই পুরুষদের সবাইকে হত্যা করেছে বলেই ধারণা করছে তারা। আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। শিশুদেরকে নিয়ে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে অবশেষে আরও ২৫ জনের একটি দলের সঙ্গে তারা বাংলাদেশে এসেছে। আরেকটি বর্ণনা পড়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। আর্মিরা পরিবারের পুরুষকে না পেয়ে একটি শিশুকে আছাড় মেরে তার কোমরের হাড্ডি ভেঙে দিয়েছে। পরিবারের লোকজন সেই কোমর ভাঙা শিশুকে নিয়ে না খেয়ে না দেয়ে বনে জঙ্গলে কাটিয়েছে তিনদিন। অবশেষে না পেরে আরও কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে পৌঁছাতে পেরেছে বাংলাদেশে।

ঘটনার কোনও শেষ নেই। ছোট ছোট শিশুদের জবাই করার ঘটনাও জানা যাচ্ছে। কোনও কোনও শিশুকে আবার পানিতেও ছুড়ে মারছে। একজন মা তার পাঁচটি শিশুকে নিয়ে এসেছে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। অনাহারে থেকে শিশুগুলোর পেটের চামড়া পিঠের সঙ্গে লেগে গিয়েছে বলে বর্ণনা করেছে এক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক।

প্রতিদিনের এসব ঘটনা পড়ার পর আমার ১৩ বছরের সন্তানের প্রশ্ন, ‘মা, এসব শিশুর ভবিষ্যৎ কী? কেউ কি ভাবছে এদেরকে নিয়ে? এরাতো কিছুই বুঝে না এখনও। এই যে না খেয়ে আছে তাদের কষ্ট হচ্ছে না? তারা পড়াশুনা করবে কোথায়?’ সন্তানের এতসব প্রশ্ন আমাকেও চিন্তিত করে। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা অনুভব করি। এই শিশুগুলোওতো আমার সন্তানের মতই মানুষ। তারাওতো জন্ম নিয়েছিলো এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের পরিচয়ে বেঁচে থাকবে বলে। অথচ আজকে তাদের পরিচয় মানুষ নয়, রোহিঙ্গা। শিশুদেরকে বলা হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা শিশু’। এই বাচ্চাগুলোর কি কোনোদিন কোনও নাম হবে না? আমার আপনার সন্তানদের যেমন সুন্দর একটি নাম আছে তাদেরও নিশ্চয়ই একটা নাম রাখা হয়েছিলো। কিন্তু নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আজকে তারা নাম পরিচয়হীন।

বেঁচে থাকাই যাদের জন্য আজকে বড় একটি প্রশ্ন সেখানে পড়াশুনাতো স্বপ্নের মতই। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কোথাও তাদের জন্য কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম নেয়নি। তিনদিন চারদিন ধরে না খাওয়াকেই এই শিশুগুলো বেছে নিয়েছে তাদের নিয়তি বলে। তারা জেনেছে তাদের কোনও আপন দেশ নেই, থাকার জন্য কোনও ঘর নেই, খাবার জন্য পছন্দসই কোনও খাবার নেই। তাদের জীবনটাই এখন হয়ে গেছে পরগাছা।

আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলো থেকে জানা যায় ৭০ এর দশক থেকেই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের কাহিনির শুরু। এ বছরের ২৪ আগস্টের আগে পর্যন্ত সেখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গা ছিল বলে জানা গেছে। সেখান থেকে এবারের ধাক্কায় বাংলাদেশেই এসেছে প্রায় ৩ লাখের মতো। আগে ছিল আরও প্রায় ৬ লাখের মতো। তাহলে মিয়ানমারের মতো একটি বৃহৎ দেশে এখন বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকেরও কম রোহিঙ্গা আছে। এই রোহিঙ্গারা কিন্তু মিয়ানমারেরই নাগরিক। বাংলাদেশের নয়। আরাকান রাজ্যে তাদের বসবাস শত শত বছর আগে থেকেই। কারো কারো তিন পুরুষ সেখানে বসবাস করছে বলেও জানা গেছে।

অথচ সু চি’র সরকারের বদান্যতায় সেই তিন পুরুষের বসত ভিটা ছেড়ে আজকে তারা পরবাস খাটছে বাংলাদেশের সীমান্তে। সানজিদা নামে একজন সাংবাদিকদের বলেছে সে ছোটবেলা থেকেই রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত হতে দেখেছে কিন্তু নিজেকে কখনও দেশ ছাড়তে হবে এমনটা ভাবেনি। এর পেছনে সে দায়ী করেছে সু চি’কে। সানজিদার স্বামী জেলে আছে। সু চি’কে সে ‘রাক্ষুসী’ মনে করে। দেশে ফিরে গেলেই ‘রাক্ষুসী’র হাতে কুচিকুচি হয়ে যেতে হবে বলে মনে করে সানজিদারা। কী ভয়ানক অবস্থা।

একজন শান্তিতে নোবেলজয়ীর ব্যাপারে সেদেশরই একজন নাগরিকের এমন ভয়ানক মন্তব্য। এ কী নোবেল কমিটি কখনও ভেবে দেখেছিলো? নোবেলের প্রবক্তা আলফ্রেড নোবেল যার নামে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পুরস্কারটি প্রবর্তন করা তার নামের প্রতি কি অবিচার হয় না এর মাধ্যমে?

এই ‘মহান নারীকে’ যেন কোনও কিছুই ছুঁতে পারছে না। তিনি হত্যা আর নির্যাতনের প্রতিজ্ঞায় অটল রয়েছেন। বিশ্বে যদি হত্যা এবং নির্যাতনের জন্য কোনও পুরস্কার দেওয়া হতো আমি নিশ্চিত এই সু চি সেই পুরস্কার জিতে নিতেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

সিরিয়ার সীমান্তে এক আইলান কুর্দির লাশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলো সারা বিশ্বকে। কিন্তু মিয়ানমারের শত শত আইলানের লাশ, ক্ষুধার্ত শিশুটির কান্না খুব একটা নাড়াতে পারছে না বিশ্ব বিবেককে। কাগজে কলমে এক হাজার জানা গেলেও একজন রোহিঙ্গার বর্ণনায় জানা যায় প্রায় তিন হাজারের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এর মধ্যেই। এত খুনের পরও একে কেন গণহত্যা বলা হবে না? আর গণহত্যার দায়ে কেন সু চি’কে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হবে না সে উত্তর কে দেবে? আব্দুল মতলব নামের এক রোহিঙ্গার শরণার্থীর ভাষায় জীবন যেন- ‘দইজ্জার ফেনা’। কচুরিপানার মতই এরা টলমলে অবস্থায় থাকে। এরা কেবল ভেসে বেড়ায়। শেকড়ে পৌঁছাতে পারে না। নিজ দেশে এরা নাগরিকত্ব পায় না। একবার এই পাড়ে আবার অই পাড়ে ভেসে যায় আর আসে। একটা সময় রাখাইনদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি হলেও এখন তারা সংখ্যালঘু। রাখাইনরা এসে তাদের ওপর চোটপাট নেয়। জমিজামা দখল করে নেয়। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দখল করে নেয় সবকিছু। আর মতলবরা হয়ে যায় ভাসমান রোহিঙ্গাদের একজন।

এমন অনেক পরিবারের কাহিনি ওঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। এসব কাহিনি আরও বেশি করে আসা উচিত। প্রকাশ করা উচিত বিশ্ব গণমাধ্যমে। মিয়ানমার সরকারের এমন নিষ্ঠুরতার প্রমানগুলোকে বিশ্ববিবেকের সামনে তুলে ধরতে হবে। নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, হত্যা লুণ্ঠনের দায়ে মিয়ানমার তথা তার সরকারকে জবাবদিহিতার আওয়তায় আনার জন্য বারেবারে কথা বলতে হবে সব জায়গাতেই। এমন মানবতাবিরোধী কাজ যদি বিচারহীন থেকে যায় তাহলে ইতিহাস কখনও কাউকে ক্ষমা করবে না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের এই বর্বরতাকে তুলে ধরুন। জাগিয়ে তুলুন সবাইকে যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন গণহত্যা চালানোর সাহস না পায়।

লেখক:

আরো কিছু পোস্টঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *